Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ভরা ফাল্গুনে কালবৈশাখীর তুতো ভাই

সূর্য সবে উঠব-উঠব করছে। আচমকা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। ডালপালায় মৃদু দুলুনি। ক্রমশ বাতাসের তেজ বাড়ল। গাছে গাছে উথালপাথাল। ডালগুলো পাগলের মতো মাথা হেলিয়ে এক বার ডাইনে, এক বার বাঁয়ে নুয়ে পড়ছে! ছেঁড়া পাতার রাশি ঘুরছে পাক খেয়ে খেয়ে। ধুলোয় চারপাশ অন্ধকার। বৃষ্টি যদিও হয়নি। তবে শুক্রবার, মাঝ ফাল্গুনের ভোরে যেন গ্রীষ্মের কালবৈশাখীরই চেহারা দেখে ফেলল কলকাতা!

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৪ ০৯:১৬
Share: Save:

সূর্য সবে উঠব-উঠব করছে। আচমকা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। ডালপালায় মৃদু দুলুনি। ক্রমশ বাতাসের তেজ বাড়ল। গাছে গাছে উথালপাথাল। ডালগুলো পাগলের মতো মাথা হেলিয়ে এক বার ডাইনে, এক বার বাঁয়ে নুয়ে পড়ছে! ছেঁড়া পাতার রাশি ঘুরছে পাক খেয়ে খেয়ে। ধুলোয় চারপাশ অন্ধকার।

বৃষ্টি যদিও হয়নি। তবে শুক্রবার, মাঝ ফাল্গুনের ভোরে যেন গ্রীষ্মের কালবৈশাখীরই চেহারা দেখে ফেলল কলকাতা!

চেহারায় মিল থাকলেও আবহবিদেরা অবশ্য এটিকে পুরোদস্তুর কালবৈশাখী বলছেন না! তাঁদের বক্তব্য: চরিত্রে সাদৃশ্য আছে ঠিকই, কিন্তু এর সঙ্গে কালবৈশাখীর জন্মগত ফারাক বিস্তর। ক্যালেন্ডারে ফাল্গুন মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গিয়েছে। নিয়ম মতে, ফাল্গুনের শেষ বা চৈত্রে টানা ক’দিনের প্রচণ্ড গরমের পরে এক সন্ধ্যায় আকাশ কালো করে আসে। তুমুল ঝড় ওঠে। ঝড় থামলে নামে বজ্র-বিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি, যা তাপমাত্রাকে এক ধাক্কায় নামিয়ে দেয়। সেই ঝড়েরই নাম কালবৈশাখী। চাঁদিফাটা গরমে গলদঘর্ম মানুষ তার মুখ চেয়ে বসে থাকে। আবহবিদেরা বলছেন, অনেক সময় ভোর বা সকালের দিকেও কালবৈশাখী হানা দেয়।

কিন্তু এ দিনের হানাদারের সঙ্গে ভোরের কালবৈশাখীর চারিত্রিক কিছু মিল খুঁজে পেলেও উৎপত্তিগত মিল তেমন পাওয়া যায়নি। আবহবিদেরা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক যে পদ্ধতিতে এ দিনের ঝড়ের উৎপত্তি, কালবৈশাখী সৃষ্টির রসায়নের সঙ্গে তার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ফলে ঝড়টাকে কী নামে অভিহিত করা যায়, তা ভেবে সকাল থেকেই ধন্দে পড়েছিলেন ওঁরা। কী বলা যায়?

এটিকে আপাতত কালবৈশাখীর ‘তুতো-ভাই’য়ের মর্যাদা দিচ্ছে হাওয়া অফিস। আলিপুর আবহাওয়া অফিসের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথের কথায়, “বলতে পারেন, কালবৈশাখীর মাসতুতো ভাই। চরিত্রগত ও উৎপত্তিগত ভাবে দুই ঝড়ে কিছু মিল থাকলেও অমিলই বেশি।” বস্তুত এ দিন ঝড়ের পরে যদি বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি নামত, তা হলে ব্যাপারটা আরও গুলিয়ে যেত বলে মনে করছেন আবহবিদদের অনেকে।

কালবৈশাখী জন্মের বিজ্ঞানটা ঠিক কী?

আবহ-বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা: ঝাড়খণ্ড ও লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা টানা ক’দিন স্বাভাবিকের অনেকটা বেশি থাকলে সাঁওতাল পরগনায় একটা নিম্নচাপ-এলাকা গজিয়ে ওঠে। তার জেরে গরম হাওয়া উপরে উঠতে শুরু করে। সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্প ধেয়ে এসে নীচের বায়ুস্তরের শূন্যস্থান পূরণ করে। তখন বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে থাকে তুলনায় ঠান্ডা বাতাস, যা নীচের স্তর থেকে ওঠা গরম বাতাসের সংস্পর্শে এলে উল্লম্ব মেঘ তৈরি হয়। বায়ুমণ্ডলের নিচু স্তরে জলীয় বাষ্প যত বেশি ঢোকে, উল্লম্ব মেঘের উচ্চতা তত বাড়ে। সেই মেঘপুঞ্জ যখন জলীয় বাষ্প আর ধরে রাখতে পারে না, তখন তা ভেঙে গিয়ে জন্ম দেয় কালবৈশাখীর। ঘণ্টায় ৫০-১০০ কিলোমিটার গতিবেগে ঝড় বয়। ঝড় থামলে বৃষ্টি, সঙ্গে ঘন ঘন বাজ।

কালবৈশাখী জন্মের মূল এই যে প্রাকৃতিক পদ্ধতি, অর্থাৎ গরম হাওয়ার ঊর্ধ্বগমন এবং উপরের শীতল বাতাসের সঙ্গে মিলে উল্লম্ব মেঘ সৃষ্টি, সেটাই এ দিন অনুপস্থিত ছিল। তা হলে ঝড় তৈরি হল কী ভাবে?

আবহবিদদের ব্যাখ্যা: এর পিছনে রয়েছে উত্তর ভারত থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস ও বঙ্গোপসাগরের জলীয় বাষ্পপূর্ণ হাওয়ার সংঘাত। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপরের স্তরের বায়ুমণ্ডলে এখন বিরাজ করছে উত্তর থেকে আগত ঠান্ডা বাতাস। আবার মধ্য ভারতের উপরিস্থিত একটি বিশেষ বায়ুপ্রবাহ আরবসাগর-বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প টেনে আনছে, যা গিয়ে জমা হচ্ছে উপরের স্তরে। উত্তর ভারত থেকে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিবেগের ঠান্ডা বাতাস সেই জলীয় বাষ্পকে ঠেলে নিয়ে এসেছে ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গের দিকে। ঝাড়খণ্ড হয়ে এ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে ঢুকতে ঢুকতে জলীয় বাষ্প ফুরিয়ে গেলেও উপরের বায়ুমণ্ডলের ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গিয়েছে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে।

আর তার দৌলতেই এ দিন সকালের অ-কালবৈশাখী ঝড়। গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার। সম্পৃক্ত জলীয় বাষ্প থেকে এ দিন ঝাড়খণ্ড ও এ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিও হয়েছে, তবে সেখানে ঝড় বয়নি। আলিপুরের তথ্য অনুযায়ী, বাঁকুড়া-বীরভূম-বর্ধমানের একাংশে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ১০-১৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। পূর্বাভাস, মধ্যপ্রদেশের উপরে ‘বিশেষ’ বায়ুপ্রবাহ এখনও উপস্থিত। পাশাপাশি উত্তর ভারত থেকে উচ্চ গতির বাতাসও পরিমণ্ডলে ঢুকছে। দুইয়ে মিলে আগামী দিন দুয়েক পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে বৃষ্টি হতে পারে।

কালবৈশাখীর তুতো-ভাইয়ের দেখা আর কি মিলবে?

আবহবিদেরা তা বলতে পারেননি। ওঁদের বক্তব্য, রোজ রোজ এমন বিশেষ পরিস্থিতি হয় না। “প্রকৃতির আচরণে বিপুল বৈচিত্র। সব সময়ে নিয়ম মেনে সব কিছু ঘটে না। কালবৈশাখীর তুতো ভাইও অস্বাভাবিক ঘটনা।” মন্তব্য এক আবহবিদের।

সেই অস্বাভাবিক ঘটনারই সাক্ষী রইল শুক্রবার ভোরের মহানগর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

storm
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE