ডেলো বাংলোর সেই ঘর আর সারি দেওয়া কুর্সি। —ফাইল চিত্র।
কোথায় মিটিংটা হয়েছিল দাদা?
সিঁড়ি দিয়ে উঠে রিসেপশনে পৌঁছেই ওঁরা ছুড়ে দিচ্ছেন প্রশ্নটা। কখনও ফিসফিসিয়ে, কখনও গলা ছেড়ে। অত্যুৎসাহীদের কেউ কেউ মিটিং হল-এর নরম সোফায় বসে ছবি তুলে নিচ্ছেন ফটাফট।
পৌষালি শীতে হাতে-গরম ডেলো-নিজস্বী!
সারদার ধাক্কা সামলাতে শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা হিমশিম খাচ্ছেন, ঠিকই। অথচ সেই সারদার কল্যাণেই কালিম্পঙের ডেলো পাহাড়ের বনবাংলোয় কিন্তু ভিড় জমাট হচ্ছে। সমস্যা একটাই। বাংলোর কর্মীরা গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছেন পর্যটকদের হাজারো প্রশ্ন সামলাতে।
মিটিংটা কোথায় হল? কে কে এলেন? কে কোথায় বসলেন? কী খেলেন? আপনারা কী কী দেখলেন?
বাঙালির কৌতূহলের শেষ নেই। সারদার বাজারে ডেলো যে এখন অন্যতম হটস্পট!
বোমাটা প্রথম ফাটিয়েছিলেন বাম নেতা গৌতম দেব। ২০১২ সালের মার্চ মাসের সেই ‘মিটিং’ নিয়ে প্রথম মুখ খুলেছিলেন তিনি। দাবি করেছিলেন, ডেলো পাহাড়ে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে নিজে মিটিং করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও মমতার বক্তব্য ছিল, দু’একটি অনুষ্ঠানে দেখা হওয়া ছাড়া সুদীপ্তকে তিনি সে ভাবে চিনতেনই না। সারদার সাম্রাজ্য সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানতেন না।
তার পর তো তিস্তা দিয়ে অনেক জলই গড়াল। সারদা তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে গেল। শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদরা জেলে ঢুকতে লাগলেন। জেলে বসেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের উদ্দেশে লেখা কুণাল ঘোষের বিবৃতিতে উঠে এল ডেলো-বৈঠকের বিবরণ।
কুণাল দাবি করলেন, ডেলোর বৈঠকে মমতা ও মুকুল রায়ের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন সুদীপ্ত এবং সারদার সিইও সোমনাথ দত্ত। কুণাল নিজেও ছিলেন। সেই বৈঠকে পর্যটনে রাজ্যের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সারদার যোগদান এবং ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে মমতাকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রচার করতে সারদা মিডিয়ার প্রসার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বলে কুণালের দাবি। বিবৃতিতে কুণাল এমনও লেখেন যে, গোটা ব্যাপারটাই ছিল “গোপনীয়তা/নাটকীয়তায় ভরা। আমরা সবাই বোকা বনেছি।”
ব্যস, বাঙালির চায়ের দোকান থেকে সোশ্যাল মিডিয়া ডেলোর টিআরপি বাড়তে লাগল চড়চড় করে। মান্না দে-র বিখ্যাত গানের প্যারোডি তৈরি হল, “ডেলো পাহাড়ের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...।” আর শুধু গালগল্পেই বা আটকে থাকা কেন? সংবচ্ছরে এক বার করে দীঘা-পুরী-দার্জিলিং ঘুরতে যাওয়া বাঙালি ট্যুরিস্ট আজকাল পাহাড়ে এলেই ডেলো বাংলোতেও ঢুঁ মেরে নিচ্ছেন। সারদায় ভর করেই বাড়ছে ডেলোর স্থানমাহাত্ম্য।এত কাল পাহাড়ে এসে কেউ কেউ কালিঝোরার বাংলো দেখতে যেতেন। ‘অনুসন্ধান’ ছবির জন্য অমিতাভ বচ্চন ওই বাংলোর সামনে দিয়েই ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন কি না! শাহরুখ খানের ‘ম্যায় হুঁ না’ ছবির পর সেন্ট পলস স্কুলেও ঘুরে আসতেন অনেকে। কেভেন্টার্স-এ ভিড় বরাবর ছিল। ‘বরফি’র পর শতাব্দীপ্রাচীন ক্লক টাওয়ারকে পিছনে রেখে ছবি তোলার ধুমটা নতুন। কিন্তু আর্থিক কেলেঙ্কারিও যে একটা জায়গাকে বিখ্যাত করে দিতে পারে, এমনটা আগে ভাবা যায়নি তেমন। ২০১৪-র ডিসেম্বরে ডেলো পাহাড় কিন্তু জনপ্রিয়তায় সান্দাকফু বা লাভা-লোলেগাঁও-এর সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছে। দশ টাকার টিকিট কেটে বাংলোটি চোখের দেখা দেখতে ভিড় করছেন পর্যটকরা।
বছর দুয়েক আগেও গ্রীষ্ম বা পুজোর মরসুম ছাড়া ডেলো বাংলো চত্বরের নেচার পার্কে লোকজনের আনাগোনা ছিল সামান্যই। বাংলোর এক কর্মী বললেন, “ডিসেম্বরে দিনে ১০০ টিকিট বিক্রি হতো কি না সন্দেহ। এখন গড়ে দিনে হাজার দেড়েক টিকিট বিক্রি হচ্ছে। শীতেও গড়ে রোজ ৫০০ জন পর্যটক ঢুকছেন।” ফাঁক বুঝে কর্মীদের কানের কাছে ফিসফিস করছেন, “কে কোথায় বসেছিলেন একটু বলুন না...।” জিটিএ-র অফিসাররা বিব্রত মুখে বলছেন, “প্লিজ, সারদা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নয়।” কেউ হেসে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন, কেউ বা মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, “ও নিয়ে কিছু বলা যাবে না।” কিন্তু ভবি ভুলছে কই?
ঘোড়ায় চড়ে বাংলোর দিকে রওনা দেওয়ার সময়ে দক্ষিণ কলকাতার এক পর্যটক মন্তব্য ছুড়ে দিলেন, “যাই মিটিংটা সেরে আসি।’’ শুনে বাকিদের মধ্যে হাসির রোল উঠল। ঘোড়ার মালিকও হাসলেন। বললেন, “আমিও টিভিতে দেখেছি, এখানে সারদা-কর্তা নাকি মিটিং করে গিয়েছেন। সবাই প্রশ্ন করে পাগল করে দিচ্ছে। হুঁ-হাঁ করে ম্যানেজ করছি।”
ডেলো থেকে এক সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে মোহিত হয়েছিলেন সুবাস ঘিসিঙ্গ। তাঁর আমলেই ১৯৯৩ সালে ১৬ ঘরের বাংলোটি তৈরি হয়। এখন এটা গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ)-এর অধীনে। সারদার সঙ্গে এই ভাবে নাম জুড়ে যাওয়ার ‘প্যাকেজিং’টা অবশ্য সকলের পছন্দ হচ্ছে না। তৃণমূলের পাহাড় কমিটির এক মুখপাত্র বিন্নি শর্মা বললেন, “ডেলো-সারদার প্যাকেজ কখনওই গ্রহণযোগ্য নয়।” অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগের মুখপাত্র প্রতাপ খাতি বলছেন, “শুনেছি, ডেলো বাংলোয় সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন মিটিং করেছেন। কিন্তু সেই কারণে ডেলো জনপ্রিয় হয়েছে, এটা ঠিক নয়।” তাঁর দাবি, ডেলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্ষণে ক্ষণে বদলে-যাওয়া রঙ দেখে বরাবরই মুগ্ধ হন পর্যটকরা।
জিটিএ সদস্য তথা পর্যটন বিষয়ক কমিটির উপদেষ্টা দাওয়া লেপচা কিন্তু বাস্তববাদী। মোর্চা এখন তৃণমূলের হাত ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে গিয়েছে। ফলে সারদার নাম জড়িয়ে পর্যটন বাড়লে আদৌ আপত্তি নেই তাঁর। মুচকি হেসে দাওয়া বলেন, “বিতর্ক মানে প্রচারের আলো। তাতে পর্যটনের প্রসার হলে স্থানীয়দের উপার্জন বাড়ে। মন্দ কী?”
সারদায় সর্বনাশ তো ডেলোয় পৌষমাস!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy