Advertisement
E-Paper

মান বাঁচাতে সাসপেনশন, ছড়ি ঘোরান অলোকেরাই

পরিস্থিতি বেগতিক বুঝলে সাসপেন্ড। চাপ আরও প্রবল হলে বহিষ্কার। শাস্তির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন দলীয় নেতৃত্ব। কিছু দিন যেতে না যেতেই দেখা যাচ্ছে, শাস্তিপ্রাপ্ত নেতা তাঁর সংশ্লিষ্ট এলাকায় আবার স্বমহিমায়! তৃণমূলে দলীয় শাস্তির রাজনীতি এমনই! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে শৃঙ্খলার গুরুত্ব নিয়ে এমন প্রশ্নকে ফের সামনে এনে ফেলেছে বর্ধমানের জামুড়িয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০৯
বহিষ্কৃত নেতা অলোক দাস। —ফাইল চিত্র

বহিষ্কৃত নেতা অলোক দাস। —ফাইল চিত্র

পরিস্থিতি বেগতিক বুঝলে সাসপেন্ড। চাপ আরও প্রবল হলে বহিষ্কার। শাস্তির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন দলীয় নেতৃত্ব। কিছু দিন যেতে না যেতেই দেখা যাচ্ছে, শাস্তিপ্রাপ্ত নেতা তাঁর সংশ্লিষ্ট এলাকায় আবার স্বমহিমায়! তৃণমূলে দলীয় শাস্তির রাজনীতি এমনই!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে শৃঙ্খলার গুরুত্ব নিয়ে এমন প্রশ্নকে ফের সামনে এনে ফেলেছে বর্ধমানের জামুড়িয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা। শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানায় দাদাগিরির অভিযোগে সেখানকার এক যুব নেতা অলোক দাসকে মাস তিনেক আগে বহিষ্কার করেছিল তৃণমূল। বহিষ্কার না সাসপেন্ড, তা নিয়েও অবশ্য দ্বিমত আছে! বর্ধমানের জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব বলছেন বহিষ্কার। রাজ্যের শীর্ষ নেতাদের একাংশের আবার যত দূর মনে পড়ছে সাসপেন্ড! বহিষ্কার বা সাসপেন্ড যা-ই হোক না কেন, নিয়মিতই ব্লক যুব কার্যালয়ে বসে স্বাভাবিক কাজকর্ম করে গিয়েছেন অলোক। এখন আবার তাঁর বিরুদ্ধেই মিড-ডে মিলে নিজের লোক নিয়োগের দাবিতে একটি স্কুলের কর্তৃপক্ষকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, সেই কাজ তিনি করেছেন তৃণমূলের পরিচয় ব্যবহার করেই!

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থার তা হলে মানে কী? কেউ কেউ তুলনা টানছেন, ভাঙড়-কাণ্ডের জেরে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার হওয়ার পরেও তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামের দাপট যেমন এলাকায় কমেনি, অলোকের ঘটনাও তেমন। দলের ভাবমূর্তি বাঁচানোর স্বার্থে নেতারা প্রয়োজনমাফিক শাস্তির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেন। কিন্তু বাস্তবে আরাবুল-অলোকদের দাপট কমে না! এলাকায় সংগঠন বাঁচানোর জন্য, ভোটের ঝুলি ভরানোর জন্য ‘তাজা ছেলে’ বা ‘দক্ষ সংগঠক’দের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষ নেতৃত্বই বা অস্বীকার করেন কী করে!

রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে জামুড়িয়ার অলোকই তৃণমূলে শাস্তি পাওয়ার একমাত্র নজির নয়। দল-বিরোধী কাজ বা দলের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার দায়ে কুণাল ঘোষ বা শিখা মিত্রদেরও সাসপেনশন ঘোষিত হয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। কিন্তু তৃণমূল ছাড়ার দিন পর্যন্ত চৌরঙ্গির প্রাক্তন বিধায়ক শিখা দাবি করে গিয়েছেন, তিনি সাসপেনশনের কোনও চিঠি পাননি। সারদা-কাণ্ডে দলের উপর তলার দিকে আঙুল তুলে সাসপেন্ড হওয়ার পরে একই দাবি করেছেন রাজ্যসভার সাংসদ কুণালও। বিরোধী দলের এক নেতার প্রশ্ন, “দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার এবং জেলে যাওয়ার পরে কুণালকে তো স্বাভাবিক নিয়মে বহিষ্কার করার কথা। সেটা কি হয়েছে?” শিখা বা কুণাল হয়তো রাজ্য স্তরের পরিচিত নাম। জেলায় জেলায় এই রকমই জানা-অজানা অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। নদিয়ার বিএড কলেজে ছাত্র-ভর্তি করানোকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগে দলীয় নেতৃত্বের কোপে পড়েছিলেন তৃণমূলের ছাত্র-নেতা তন্ময় আচার্য। কিন্তু তাঁর কাছেও সাসপেনশনের চিঠি পৌঁছেছে বলে খবর নেই!

নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করলে শাস্তির বিধান সব দলই দেয়। ক্ষমতায় থাকার সময়ে সিপিএম-ও দিত এবং এখনও দেয়। তবে রাজ্যে দীর্ঘদিন যে হেতু সিপিএমের শাসন ছিল এবং তাদের সাংগঠনিক ব্যবস্থা অনেক বেশি গোছালো, তার তুলনায় শাসক তৃণমূলের শিথিলতা একটু বেশি করেই চোখে পড়ছে বলে অনেকের মত। বাম জমানায় দমদমে জোড়া খুনে অভিযুক্ত দাপুটে নেতা দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বা চিকিৎসক হত্যায় নাম জড়ানোয় বালির নেতা বিশ্বজ্যোতি বসুকে যেমন বহিষ্কার করেছিল সিপিএম। পাশাপাশি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। আবার দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন সাংসদ অলোকেশ দাসকে রাজ্য কমিটি থেকে অবনমন দিয়ে জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ‘শত্রু-শিবিরের সঙ্গে যোগসাজশ’ রাখার দায়ে বহিষ্কৃত হতে হয়েছিল শ্রমিক নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্যকে। প্রায় ৬ বছর পরে তাঁকে অবশ্য দলে ফিরিয়েও নেওয়া হয়। ফিরতে চাইলে বহিষ্কৃত নেতাকে দলের কন্ট্রোল কমিশনের (পার্টি আদালত) কাছে আবেদন করতে হয়। সিপিএমের

এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, “সাসপেনশন বা বহিষ্কারের নজির আমাদের দলের বিভিন্ন স্তরে অজস্র আছে। কারণ, এ সব কিছুরই লিখিত বিধি-নিয়ম আছে।”

সিপিএমের নিয়ম অনুযায়ী, দলের কারও বিরুদ্ধে গুরুতর কোনও অভিযোগ উঠলে প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিস এবং তার পরের ধাপে সাসপেন্ড করা হয়। সাসপেন্ড মানে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক সদস্যপদ সাময়িক ভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। এই সময়টায় শাস্তিপ্রাপ্ত নেতাকে সংশ্লিষ্ট কমিটির ভারপ্রাপ্ত নেতার অধীনে কাজ করতে হয়। তাঁর আচরণ ভাল বলে মনে করলে সেই ভারপ্রাপ্ত নেতা (শাখা কমিটি হলে শাখা সম্পাদক বা লোকাল কমিটি হলে লোকাল সম্পাদক) নির্দিষ্ট সময়ের পরে দলকে সুপারিশ করেন সাসপেনশন প্রত্যাহার করার জন্য। আচরণ না শোধরালে বা তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে সাসপেনশনের পরিণতি হয় বহিষ্কার। আবার কোনও ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দলের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করা বা পার্টি লাইন অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করলে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ না দিয়ে পত্রপাঠ বহিষ্কার করে দেওয়ার সংস্থানও কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্রে আছে। সেই সংস্থান ব্যবহার করেই সাম্প্রতিক কালে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা বা লক্ষ্মণ শেঠের মতো নামী নেতাদের বহিষ্কার করেছে সিপিএম।

প্রশ্ন হচ্ছে, এত সব নিয়ম মানার চল কি তৃণমূলে আছে? তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, দলীয় গঠনতন্ত্র মেনেই তাঁদের দল চলে। এবং সেই গঠনতন্ত্র কংগ্রেসের মতোই। কংগ্রেসেও চিঠি দিয়ে সাসপেনশনের সিদ্ধান্ত জানাতে হয়। আচরণ ঠিক থাকলে সাসপেনশন প্রত্যাহার করা যায়। আবার অপরাধের গুরুত্ব বুঝে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার এবং চিরতরে বহিষ্কার, দুই-ই করা যায়। বহিষ্কৃত নেতাকে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট কমিটির উপরে। কংগ্রেসের এক নেতার

কটাক্ষ, “আমাদের দলীয় সংবিধান কবে কী সংশোধন হয়েছে, সবই সদস্যদের দেওয়া হয়। তৃণমূল মুখে বললেও কখনও দলীয় সংবিধান দিয়েছে কাউকে? সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হচ্ছে বলে তার অনেক আগেই ফিরিয়ে এনে লোকসভায় প্রার্থী করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী!”

ঘটনা হল, শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি নামে একটি কমিটি কিন্তু তৃণমূলে আছে। যাতে আছেন মুকুল রায়, সুব্রত বক্সী এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এত দিন জেলা স্তরে কোনও শাস্তির সিদ্ধান্ত হলে রাজ্য নেতৃত্বকে সেটা অবহিত করতে হতো। এখন নিরন্তর চাপের মুখে তাতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। মহাসচিব পার্থবাবুর কথায়, “এখন পদ্ধতিটা সহজ হয়ে যাচ্ছে। এ বার থেকে দলে নতুন কাউকে নিতে গেলে বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে এই কমিটির মাধ্যমে পাশ করাতে হবে।”

তাতে কি শৃঙ্খলার পরীক্ষায় পাশ করবে তৃণমূল? সংশয় রেখে দিচ্ছে জামুড়িয়ার অলোকের মন্তব্যই। যিনি বলেছেন, “দলের শো-কজের চিঠির উত্তর দেওয়ার পরে আমাকে সাসপেন্ড না বহিষ্কার করা হয়েছে, আমি জানি না!” আর সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত রেজ্জাকের মন্তব্য, “কালীঘাট কোম্পানির আবার নিয়ম-কানুন! তা-ই নিয়ে আবার এত কথা!”

alok das tmc suspension aloke das mamata bandyopadhyay burdwan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy