সিবিআই আদালতের বিচারকের কাছে তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের লিখিত অভিযোগ ছিল জেল হাজতে পাঠানো পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রকে হাসপাতালে রাজার হালে রাখা হলেও তাঁর বেলায় অন্য ব্যবস্থা। ওই দিনই আদালতের নির্দেশে জেলে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-মুকুল রায় সম্পর্কে তাঁর বয়ানও রেকর্ড করে সিবিআই। ঘটনাচক্রে তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, শুক্রবার জেলে গিয়ে কুণালকে পরীক্ষা করলেন মনোচিকিৎসক ও মনোবিদদের একটি দল।
দু’টি ঘটনাকে এক সঙ্গে জুড়ে কুণাল-ঘনিষ্ঠদের দাবি, এ সবই তাঁকে মানসিক ভাবে অসুস্থ প্রমাণ করার চেষ্টা। তাঁদের অভিযোগ, কুণালকে মানসিক ভাবে অসুস্থ প্রমাণ করতে পারলে বলা যাবে মমতা-মুকুল নিয়ে তাঁর অভিযোগও ভিত্তিহীন। কুণাল নিজেও চিকিৎসকদের কাছে একই অভিযোগ করেন। কেন তাঁদের এ কথা মনে হচ্ছে? কুণাল-ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল সমর্থকের কথায়, “কুণাল এসএসকেএম থেকে জেলে ফিরেছেন প্রায় এক মাস হল। সে সময় ঠিক হয়েছিল, চিকিৎসকেরা এসে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যাবেন। অথচ এত দিন কোনও চিকিৎসক আসেননি। যখন কুণাল আদালতে জানালেন, তিনি সিবিআইকে মমতা-মুকুল নিয়ে অনেক তথ্য জানাতে চান, প্রশ্ন তুললেন মদনের হাসপাতাল বাস নিয়ে তখনই তাঁকে মনোচিকিৎসক ও মনোবিদ দিয়ে পরীক্ষা করানো হল।”
এসএসকেএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্সি জেলে কুণালের জন্য চিকিৎসক দল পাঠিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালেও মন্ত্রী মদনের জন্য তৈরি মেডিক্যাল বোর্ডকে কিন্তু এ দিনও বসাতে পারেননি! গত শুক্রবার আদালত মদনবাবুকে জেল হেফাজতে পাঠানোর পরে রাতেই তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালের বাতানুকূল কেবিনে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করা হয়। তার পর থেকে নানা রকমের পরীক্ষা চলছে মদনবাবুর। তাঁর চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত সোমবার একটি মেডিক্যাল বোর্ডও তৈরি করা হয়। কিন্তু এখনও সেই বোর্ড বসতে পারল না। কেন?
এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের জবাব, “দম আটকে যাচ্ছে বলে মন্ত্রীর এমআরআই করা যাচ্ছে না। তাঁকে অজ্ঞান করে এমআরআই করার কথা ভাবা চলছে। এর মধ্যে ২৫ তারিখ ছুটির দিন থাকায় আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ও ইকোকার্ডিওগ্রাম করা যায়নি। সেটা শুক্রবার হয়েছে। তবে রিপোর্ট পেতে বিকেল হয়ে যাওয়ায় বোর্ড এ দিনও বসেনি।” কেন ছুটির দিনের তোয়াক্কা না-করে জরুরি ভিত্তিতে আগেই পরীক্ষাগুলো করা হল না? প্রদীপবাবুর উত্তর, “ওটা বোর্ডের প্রধান শিবানন্দ দত্তের সিদ্ধান্ত। আমি তো বলেই দিয়েছিলাম যত দ্রুত সম্ভব সব করাতে।” কেন শিবানন্দবাবু ২৫ তারিখের আগেই সব পরীক্ষা শেষ করতে বলেননি? শিবানন্দবাবুর জবাব, “আমার কিছু বলার অনুমতি নেই। কথা বললেই সমস্যায় পড়ব।”
চিকিৎসকেরা বলছেন, মন্ত্রীর যে সব শারীরিক সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সবই পুরনো। তাঁদের একাংশের অভিযোগ, মদনবাবু যদি গুরুতর অসুস্থই হবেন, তা হলে তো তাঁর যাবতীয় পরীক্ষা দ্রুত হওয়ার কথা। অথচ মদনবাবুর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং মেডিক্যাল বোর্ড গড়তেই সপ্তাহ কাবার করে দিয়েছেন এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ! হল্টার টেস্টের রিপোর্ট যেখানে ২৪ ঘণ্টায় আসার কথা, লেগে যাচ্ছে ৩৬ ঘণ্টা! ঠিক কী হয়েছে মন্ত্রীর, তা বলার ব্যাপারেওনজিরবিহীন গোপনীয়তা নিয়েছে এসএসকেএম। চিকিৎসকদের একাংশ জানান, নবান্ন থেকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
কী ধরনের ডাক্তারি পরামর্শে সারদায় অভিযুক্ত মদনকে এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হল, তা নিয়ে এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি নিজেও চিকিৎসক। তাঁর বক্তব্য, “উডবার্ন ওয়ার্ডে পাঠানোর পরে অভিযুক্ত মন্ত্রীর রোগ খোঁজার জন্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে! তাঁকে নিজের মতো থাকার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। তা হলে জেল হেফাজতের মানে কী!” তাঁর প্রশ্ন, জেলের চিকিৎসকদের উপরে রাজনৈতিক চাপ দিয়ে মন্ত্রীকে রাজার হালে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না তো?
মন্ত্রী মদনকে ফাটকের বদলে দিনের পর দিন হাসপাতালের এসি ঘরে রাখার পিছনে এসএসকেএমের চিকিৎসকদের একাংশের ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না, তার তদন্ত চেয়েছেন কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানও। তাঁর বক্তব্য, “জেলের কষ্ট ভোগ না-করার জন্যই যে মদন অসুস্থতার ভান করছেন, সিবিআই তা আদালতকে জানাক। সুস্থ লোককে অসুস্থ হিসেবে দেখাচ্ছেন যে চিকিৎসকেরা, তাঁদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চাই। দরকার হলে এ নিয়েও জনস্বার্থ মামলা করব।”
শাসক দলের মর্জিতেই মন্ত্রীকে জেলের বদলে হাসপাতালে রাজার হালে রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “ এ রাজ্যে একদলীয় আধিপত্য কায়েম হয়েছে। তৃণমূল যেমন চাইবে, তেমনটিই হবে! রাজ্যের চিকিৎসক বা পুলিশ কেউই তার বাইরে নন!”
মদনকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা হলেও কুণালের চিকিৎসার জন্য শুক্রবার চিকিৎসক দল যায় জেলে। বেলা সওয়া এগারোটা নাগাদ মেডিসিন বিভাগের প্রধান নির্মলেন্দু সরকার, ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি-র মনোচিকিৎসক শিখা মুখোপাধ্যায় এবং এক জন মহিলা মনোবিদ ছিলেন সেই দলে। সূত্রের খবর, মানসিক চিকিৎসক দেখে কুণাল ক্ষুব্ধ হন। চিকিৎসকদের বলতে থাকেন, তাঁকে পাগল প্রতিপন্ন করার জন্যই কি এঁদের পাঠানো হয়েছে?
এ নিয়ে কী বলছেন চিকিৎসকেরা? ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রির চিকিৎসকদের বক্তব্য, আত্মহত্যার চেষ্টা করার সময় থেকেই কুণাল ঘোষ মানসিক অবসাদে ভুগছেন। তাঁকে এ জন্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে, তিনি নিয়মিত তা খেয়ে ভালও আছেন। চিকিৎসকদের দাবি, তাঁরা বলেননি যে কুণাল ‘পাগল’। আত্মহত্যার চেষ্টার পরে কুণালের কাউন্সেলিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই অনুযায়ী চিকিৎসকেরা এ দিন ১৫ মিনিট ‘ইনডিভিজুয়াল সাপোর্টিভ সাইকোথেরাপি’ ও ৪০ মিনিট ‘কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি’ করেন। এর উদ্দেশ্য, রোগীকে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে সাহায্য করা।
কিন্তু কুণাল যখন সিবিআই-কে মমতা-মুকুল নিয়ে তথ্য দিচ্ছেন, ঠিক তখনই তাঁকে কাউন্সেলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন? চিকিৎসকদের জবাব, নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় আগে তা করা হয়নি। এ বার থেকে তা নিয়মিতই করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy