Advertisement
১৬ জুন ২০২৪
সুশীল পাল হত্যাকাণ্ড

মনের জোরই জিতিয়ে দিল দশ বছরের লড়াই

কাঁদছেন দু’জনেই। এক জনের জিতে যাওয়ার কান্না, অন্য জনের পরাজয়ের। এক জন বলছেন, “বিচারব্যবস্থার উপরে আস্থা ছিল। তা ভুল প্রমাণিত হল না। এখন খুব শান্ত লাগছে।” অন্য জন বলছেন, “দশ বছর ধরে মিথ্যের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি। আর আজ এ কেমন বিচার পেলাম?” প্রথম জন নিহত চিকিৎসক সুশীল পালের স্ত্রী কণিকা পাল।

নিহত চিকিৎসক।

নিহত চিকিৎসক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৪৩
Share: Save:

কাঁদছেন দু’জনেই। এক জনের জিতে যাওয়ার কান্না, অন্য জনের পরাজয়ের। এক জন বলছেন, “বিচারব্যবস্থার উপরে আস্থা ছিল। তা ভুল প্রমাণিত হল না। এখন খুব শান্ত লাগছে।” অন্য জন বলছেন, “দশ বছর ধরে মিথ্যের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি। আর আজ এ কেমন বিচার পেলাম?” প্রথম জন নিহত চিকিৎসক সুশীল পালের স্ত্রী কণিকা পাল। দ্বিতীয় জন সুশীলবাবুকে হত্যার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত পেশায় চিকিৎসক পিয়ালি দাস মণ্ডল, যাঁকে সোমবার দোষী সাব্যস্ত করেছে হাওড়া জেলা ও দায়রা আদালত। দ্বিতীয় জনের কঠোর সাজা চাইছেন প্রথমা। আর পিয়ালির দাবি, সুশীলবাবুকে তিনি কখনও দেখেননি, খুন করা তো দূর-অস্ত্।

এ দিন দুপুর ২টোয় বিচারক তন্ময় গুপ্তের এজলাসে সুশীল পাল হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। ২০০৪-এর জুলাই মাসের সেই নৃশংস খুনের ঘটনার বিচার-শেষে কী রায় হয়, তা নিয়ে আইনজীবী থেকে আদালতে উপস্থিত সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল ছিল যথেষ্টই। দুপুর দেড়টার কিছু আগে দুই মেয়ে শ্রেয়া, শ্রীজা ও এক দাদার সঙ্গে আদালতে হাজির হন কণিকাদেবী। শান্ত, ধীর চেহারা। চোখেমুখেও উৎকণ্ঠার ছাপ তেমন নেই। এ দিন সকালেই বলছিলেন, “টানা দশ বছর লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। এক এক সময়ে ধৈর্য হারিয়েছি। মনে হয়েছে, এই বিচার প্রক্রিয়ার বোধহয় শেষ নেই! কিন্তু তদন্ত সংস্থা, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা আর মনের জোরে চালিয়ে গিয়েছি লড়াইটা। যে জোরের মূল উৎস ছিল আমার দুই মেয়ে।” গলায় ক্লান্তি থাকলেও নিজের লড়াইয়ের প্রতি কণিকাদেবীর আস্থাই যেন তাঁকে হতাশ হতে দেয়নি।

আদালত কক্ষে কিন্তু দেখা গেল, যাঁদের জোরে তিনি লড়েছেন, সেই মেয়েদেরও আস্থার খুঁটিটা তিনিই। ছাই আর গোলাপির উপরে ছাপা সিল্কের শাড়ি, রং মেলানো ব্লাউজ পরা মায়ের পাশে বসে মাঝেমধ্যেই কেঁদে ফেলছিল ছোট মেয়ে শ্রীজা। একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে সে। মেয়েকে সামলাচ্ছিলেন মা। ডাক্তারি প্রথম বর্ষের ছাত্রী শ্রেয়া কিন্তু তুলনায় অনেক শক্ত। সুশীলবাবুর মৃত্যুর সময়ে দুই মেয়ে পড়ত পঞ্চম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে। কর্মব্যস্ত বাবা ছুটিছাটা, অবসর পেলেই তাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ঘুরতে যাওয়ার সেই স্মৃতিগুলো আজও টাটকা দুই বোনের।

শ্রেয়ার কথায়, “বাবাই আমার আদর্শ। পেশার প্রতি ওঁর অসম্ভব নিষ্ঠা ছিল। আমার ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল চিকিৎসক হওয়ার।” এ দিনও কলেজে গিয়েছিলেন ক্লাস করতে। তার পরে এসেছেন আদালতে। আর মাকে দীর্ঘ লড়াই চালাতে দেখে, আইনের সামনে মায়ের অসহায়তা দেখে ছোট মেয়ে শ্রীজা ঠিক করেছে সে আইনজীবী হবে।

নিজের মানুষকে হারানোর পরে দশ বছর তো বটেই, সোমবারও আদালতে পৌঁছে রায় ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হতে ঘণ্টাখানেকের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে কণিকাদেবীদের। বিচারক আসার পরেও কিছুক্ষণের উৎকণ্ঠা বারবার অন্যতম অভিযুক্ত পিয়ালি দাস মণ্ডলের নাম ডাকা হচ্ছে কিন্তু তিনি হাজির হচ্ছেন না। আদালতকক্ষে গুঞ্জন, ‘এই ভাবে আদালতের সময় নষ্ট করা!’, ‘উনি তো হাজির হয়েছিলেন, গেলেন কোথায়?’ অবশেষে এক আত্মীয়ার সঙ্গে পিয়ালি ঢুকলেন আদালতে। আগেই জামিন পেয়েছিলেন তিনি। তাঁকে ঢুকতে দেখে হাতজোড় করে ঈশ্বরকে স্মরণ করল শ্রীজা। বিচারক রায় পড়তে শুরু করলেন।

আদালতকক্ষে তখন অভিযোগকারী আর অভিযুক্তদের অভিব্যক্তি ছাড়া বাকি সব নিশ্চল। রায় ঘোষণা যত এগিয়েছে, পিয়ালি ভেঙে পড়েছেন। এক সময়ে সঙ্গের আত্মীয়া তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি যে নির্দোষ, চিৎকার করে সে কথা বলারও চেষ্টা করেন পিয়ালি। রায় ঘোষণার পরে ভেঙে পড়েন তিনি।

নীল সালোয়ার-কামিজ, হাতে মেহেন্দির দাগ টাটকা, চোখে সামান্য কাজল। কাঁদতে কাঁদতে পিয়ালি টেলিফোন করতে থাকেন আত্মীয়-পরিজনদের।

তিনি বলেন, “ওরা এখনই আমার কাছ থেকে টেলিফোন কেড়ে নেবে। এ কেমন বিচার পেলাম?” জানান, দীর্ঘ দশ বছর ধরে মিথ্যে অভিযোগ বয়ে বেড়াচ্ছেন, হেনস্থা হচ্ছেন। আশা ছিল, এ দিন আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন। কিন্তু রায়ে তাঁর সেই আশাও শেষ হয়ে গিয়েছে বলে এ দিন মন্তব্য করেন পিয়ালি। বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেন নিজের দশ বছরের ছোট্ট মেয়েটার জন্য।

আদালতে উপস্থিত অন্য অভিযুক্তদের মধ্যেও তখন ক্ষোভ ছড়িয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ভেঙে পড়েছেন তাঁদের আত্মীয়েরা।

কক্ষের অন্য প্রান্তে কণিকাদেবীদের ঘিরে তখন অন্য চিত্র। রায় শুনেই কেঁদে ফেলেছিল শ্রীজা, মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কেঁদেছেন মা-ও। পরে কণিকাদেবী বলেন, “আমি খুব শান্তি পেয়েছি। উনি (সুশীলবাবু) ফিরবেন না। কিন্তু ওঁর মতো মানুষকে যাঁরা নৃশংস ভাবে খুন করেছে, তাদের কঠোরতম শাস্তি হোক এটাই চাই।” এটুকু বলেই মেয়েদের নিয়ে আদালত থেকে বেরিয়ে যান তিনি।

আর সেই আদালত থেকেই খালি হাতে ফিরেছেন পিয়ালির বাবা প্রাক্তন ব্যাঙ্ক অফিসার। চোখের সামনে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। সন্ধ্যায় পিয়ালির বাবা বলেন, “আমার যা মানসিক অবস্থা, তাতে কিছু বলার নেই! শুধু এটুকুই বলব, সুবিচার পেলাম না। এ বার উচ্চ আদালতে যেতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sushil pal konika pal high court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE