Advertisement
১৭ মে ২০২৪

মমতাকে একনায়ক আখ্যা দিয়ে নয়া বিদ্রোহী দেবব্রত

প্রায় দাবানলের মতো বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে শাসক দলে! এক এক দিন এক এক জনের বিবেক জাগ্রত হচ্ছে আর তিনি বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন! সারদা-কাণ্ডে বিধ্বস্ত এবং ভাঙনের আতঙ্কে জেরবার তৃণমূল নেতৃত্বের হৃৎকম্প প্রতিদিনই বাড়িয়ে তুলছেন কোনও না কোনও নেতা, বিধায়ক বা সাংসদ। নেতাজি জয়ন্তীর দিন সেই তালিকায় সংযোজন হল রাজ্যসভার বর্ষীয়ান সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

প্রায় দাবানলের মতো বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে শাসক দলে! এক এক দিন এক এক জনের বিবেক জাগ্রত হচ্ছে আর তিনি বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন! সারদা-কাণ্ডে বিধ্বস্ত এবং ভাঙনের আতঙ্কে জেরবার তৃণমূল নেতৃত্বের হৃৎকম্প প্রতিদিনই বাড়িয়ে তুলছেন কোনও না কোনও নেতা, বিধায়ক বা সাংসদ। নেতাজি জয়ন্তীর দিন সেই তালিকায় সংযোজন হল রাজ্যসভার বর্ষীয়ান সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।

প্রায় আচমকাই মুখ খুলে প্রাক্তন আমলা এবং অধুনা তৃণমূল সাংসদ দেবব্রতবাবু শুক্রবার তোপ দেগেছেন একেবারে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে! যে তৃণমূল নেত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের সময় বাম-বিরোধী মঞ্চে সামিল হয়েছিলেন প্রাক্তন এই ভূমি-আমলা, সেই মমতাকেই এ দিন তিনি ‘একনায়কতন্ত্রী রাজা’ আখ্যা দিয়েছেন! সারদা-কাণ্ডে জড়িতদের সাজা এবং দল থেকে বার করে দেওয়ার পক্ষে সওয়ালও করেছেন রাজ্যসভার এই সাংসদ। আবার একই সঙ্গে বলেছেন, বার করে দেওয়া যে হবে না, তা-ও জানা কথা! কারণ যিনি বার করবেন, তিনি কারও কথাই শোনেন না! তাঁর মন্তব্যের ইঙ্গিত কার দিকে, তা বুঝতে অসুবিধা কারওরই হচ্ছে না। কিন্তু তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, আমলাসুলভ কৌশলেই তিনি ‘রানি’র বদলে রাজা শব্দটি ব্যবহার করে যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিয়েছেন।

সারদা, খাগড়াগড় থেকে শুরু করে একের পর এক ঘটনায় টালমাটাল তৃণমূলে সাম্প্রতিক কালে একাধিক নেতা-মন্ত্রী প্রকাশ্যেই দলীয় অবস্থানের বাইরে মুখ খুলেছেন। মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডে, সাংসদ সুগত বসু, বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়েরা যেমন দলকে বিড়ম্বনায় ফেলেছেন, তেমনই দলনেত্রীকে চিঠি লিখে আর এক বিধায়ক স্বপন ঘোষ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাঁর অভিযোগের বিচার না হলে বাধ্য হয়ে তাঁকে ‘অন্য সিদ্ধান্ত’ নিতে হবে! প্রাক্তন আইপিএস এবং বিধায়ক সুলতান সিংহ বৃহস্পতিবারই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী এবং হাওড়া জেলায় তৃণমূলের নেতা অরূপ রায়ের বিরুদ্ধে। এই আবহে দেবব্রতবাবুর এ দিনের বিস্ফোরক মন্তব্য স্বাভাবিক ভাবেই শাসক দলের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে আবার সামনে এনে ফেলেছে। দলের এক বর্ষীয়ান বিধায়কের কথায়, “আসলে অনেকেরই অনেক কিছু বলার আছে। সাহস করে এক জন কেউ বললে আরও কেউ মুখ খুলছে। বলতে বলতেই এক দিন ঝাঁক বেঁধে বিদ্রোহ না হয়ে যায়!”

দেবব্রতবাবু এ দিন যা বলেছেন, প্রকাশ্যে বলতে না পারলেও একান্ত আলাপচারিতায় সেই সব কথা বলে থাকেন তৃণমূলের বহু নেতাই। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আশঙ্কা, বিদ্রোহের প্রবণতা যে ভাবে সংক্রামক হয়ে উঠছে, এর পরে বড় কোনও ঘটনা না ঘটে যায়! রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথায়, “কোনও অনুষ্ঠানে কোনও প্রসঙ্গে কেউ কেউ কিছু কথা বলে দেন। দেবুদা কিন্তু বাড়িতে বসে ক্যামেরার সামনে কথাগুলো বলেছেন। তার মানে বলতে হবে বলে তিনি ঠিক করেই নিয়েছিলেন।”

লক্ষ্যণীয়, সাম্প্রতিক কালে দল পরিচালনা নিয়ে যাঁরা অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন, তাঁরা সবাই প্রায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দেবব্রতবাবু সে অর্থে রাজনৈতিক মুখ নন। বরং তাঁর মিল আছে আর এক তৃণমূল সাংসদ, শিক্ষাবিদ সুগতবাবুর সঙ্গে। বাম জমানায় প্রতিবাদী বিদ্বজ্জনেদের পরবর্তী কালে মমতা যে ভাবে নানা দায়িত্বে তুলে এনেছিলেন, দেবব্রতবাবুও সেই তালিকার সদস্য। সেই জন্যই সুগতবাবুর মতো দেবব্রতবাবুর কথাকেও সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে এনেই দেখছে বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান যেমন বলেছেন, “ওঁর তো কিছু পাওয়ার নেই। যা খারাপ লেগেছে, তা-ই বলেছেন।” বিজেপি-র তথাগত রায় বা সিপিএমের সুজন চক্রবর্তীরাও কটাক্ষ করেছেন, দেবব্রতবাবুকে দিয়েই বোঝা যাচ্ছে তৃণমূলে কাঁপুনি আরও বাড়বে!

মন্ত্রিত্ব ছেড়ে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর বিজেপি-তে চলে যাওয়ার পরে তৃণমূলের অন্দরে এখন প্রবল সন্দেহের বাতাবরণ! যত নতুন নতুন নাম নিয়ে জল্পনা হচ্ছে, দলের মধ্যে একে অপরকে তত অবিশ্বাসের চোখে দেখা হচ্ছে। এবিপি আনন্দ চ্যানেলে দেবব্রতবাবুর এ দিনের মন্তব্য সম্প্রচারিত হওয়ার পরে তৃণমূল নেতৃত্বের মধ্যেও প্রাথমিক ভাবে একই রকম অবিশ্বাস কাজ করছে! তবে দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন আনুষ্ঠানিক ভাবে এ দিন রাতে বলেছেন, “ওঁর মন্তব্য আমি শুনিনি বা দেখিনি। দেখার পরে দেবব্রতবাবুর সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইব, উনি কী বলতে চেয়েছেন। তার পরে দল তার অবস্থান ঠিক করবে।” রাজ্যসভায় তৃণমূলের সচেতক ডেরেক অবশ্য আত্মবিশ্বাসী যে, সংসদের উচ্চ কক্ষে তাঁর দলীয় সতীর্থকে নিয়ে সমস্যা ‘২৪ ঘণ্টা’র মধ্যেই মিটিয়ে ফেলা যাবে।

ক’দিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা এবং দলনেত্রী মমতার সমালোচনা করে নজর কাড়ছেন লোকসভার তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে দল এখনও মুখ খোলেনি। শাস্তি দেওয়া হলে দীনেশ লোকসভার পদ বাঁচিয়ে বিজেপি-তে চলে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে দলের একাংশের। দেবব্রতবাবুকে নিয়ে অবশ্য কোনও আশা বা আগাম আশঙ্কা কিছুই নেই। তাই তাঁর মন্তব্য ভয়ঙ্কর বিস্ময় নিয়ে আছড়ে পড়েছে তৃণমূলে! দলের এক সাংসদের কথায়, “হঠাৎ দেবুদা এ সব বলে দিলেন?”

কী বলেছেন দেবব্রতবাবু? টিভি ক্যামেরার সামনে দেবব্রতবাবু বলেছেন, সারদা-কাণ্ডে প্রাথমিক ভাবে কিছু লোককে দোষী বলেই মনে হচ্ছে। শেষ কথা বলার জন্য আদালতের উপরে ভরসা রাখতে হবে। তবে দোষী বা অসৎ লোকেদের দল থেকে বার করে দেওয়াই উচিত বলে মনে করছেন তিনি। কিন্তু তাঁর আশঙ্কা, “কে বাদ দেবে তাঁদের? যাঁর দেওয়ার কথা, তিনিই তো রাজা হয়ে গিয়েছেন! একনায়কতন্ত্রী হয়ে গিয়েছেন! তবে আমি-আপনি কেউ নই। মানুষই এঁদের বাদ দেবেন। বিধায়ক পদই চলে যাবে!” সারদা-কাণ্ড নিয়ে তাঁর মন্তব্য, “এই ঘটনা অনভিপ্রেত। ক্ষমতায় থাকলে কিছু ভ্রমর ঘুরবে, ডাঁশ মশা ঘুরবে। এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই থাকবে। এদের থেকে বেঁচে

চলতে না পারলে অসুবিধা তো হবেই!” সুগতবাবুর সুরে দেবব্রতবাবুর দাবি, যাঁরা আইন ভেঙেছেন, তাঁদের শাস্তি হওয়াই উচিত। এমন কেলেঙ্কারিতে কি দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না? সাংসদের উত্তর, “কী করা যাবে? আমাদের দল সাধু-সন্তের দল নয়! সাধারণ লোকের ভিতরে যেমন সৎ-অসৎ আছে, এ ক্ষেত্রেও তা-ই।” সিঙ্গুর-প্রসঙ্গ টেনেও তির্যক মন্তব্য করেছেন দেবব্রতবাবু। বলেছেন, “সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় আমরা সবাই সাধু ছিলাম না! একটা কারণের জন্য এক হয়েছিলাম। সেই কারণ চলে গিয়েছে, আর এখন এক নই!”

দলকে জড়িয়ে যে ক্ষোভের কথা তিনি বলছেন, তা নিয়ে দলনেত্রী মমতার সঙ্গে কি কথা বলবেন? দেবব্রতবাবুর জবাব, “মমতা পরামর্শ চাইলে নিশ্চয়ই দেব। না চাইলে দেব না। কিন্তু উনি তা চান না! হতেই পারে, উনি আমার পরামর্শ চাইছেন না মানে আমার থেকে ভাল উপদেষ্টা ওঁর আছে!” তৃণমূলের এক নেতা স্মরণ করাচ্ছেন, “দেবুদা’র আত্মীয়ার বাড়ি থেকে জুলুম করে টাকা আদায় করেছিল আমাদের দলেরই লোকজন। কোনও সুবিচার উনি পাননি। দলনেত্রীকে পরামর্শ দিতে উনি যাবেন কেন?” আবার অন্য নেতার বক্তব্য, “সংসদের বিমান টিকিট কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে উনি তদন্তের মুখে পড়ার সময় দল কিন্তু পাশে দাঁড়িয়েছিল। দলের বিপদের সময় তিনি সেটা মনে রাখলেন না!” মুষল-পর্বে কে কোনটা মনে রাখে, বোঝাই তো দায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debabrata bandyopadhyay tmc mp mamata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE