Advertisement
১৯ মে ২০২৪

মল্লিকার আশঙ্কা, তদন্ত মাঝপথে বন্ধ হবে না তো

বারুদের স্তূপে দেশলাই জ্বালিয়েছিলেন তিনি। সেই আগুনের শিখা ছড়িয়েছে গোটা রাজ্যে। আঁচ পড়েছে মন্ত্রী-নেতা-প্রাক্তন আমলা, ব্যবসায়ী-ক্রীড়া প্রশাসক-শিল্পীদের গায়েও। অনেকেরই গদি টালমাটাল। যিনি সেই দেশলাইটা জ্বালিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু অন্তরালেই, তিন তলা বাড়ির এক চিলেকোঠার ঘরে। হাওড়া শহরের ছোট হয়ে আসা রাস্তা, গলি, তস্য গলি পেরিয়ে বোনঝি-র বাড়ির ছাদে মাথা গোঁজার জন্য আপাতত ওই ছোট আস্তানাটুকুই নিঃসন্তান বিধবা মহিলার ঠিকানা।

মল্লিকা চট্টোপাধ্যায়। সারদার চার সংস্থার বিরুদ্ধে  ইনিই প্রথম প্রতারণার মামলা রুজু করেছিলেন।  ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

মল্লিকা চট্টোপাধ্যায়। সারদার চার সংস্থার বিরুদ্ধে ইনিই প্রথম প্রতারণার মামলা রুজু করেছিলেন। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৮
Share: Save:

বারুদের স্তূপে দেশলাই জ্বালিয়েছিলেন তিনি। সেই আগুনের শিখা ছড়িয়েছে গোটা রাজ্যে। আঁচ পড়েছে মন্ত্রী-নেতা-প্রাক্তন আমলা, ব্যবসায়ী-ক্রীড়া প্রশাসক-শিল্পীদের গায়েও। অনেকেরই গদি টালমাটাল।

যিনি সেই দেশলাইটা জ্বালিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু অন্তরালেই, তিন তলা বাড়ির এক চিলেকোঠার ঘরে। হাওড়া শহরের ছোট হয়ে আসা রাস্তা, গলি, তস্য গলি পেরিয়ে বোনঝি-র বাড়ির ছাদে মাথা গোঁজার জন্য আপাতত ওই ছোট আস্তানাটুকুই নিঃসন্তান বিধবা মহিলার ঠিকানা।

তিনি মল্লিকা চট্টোপাধ্যায়। এখন থেকে এক বছর চার মাস সাত দিন আগে, উত্তর বিধাননগর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তিনি। সুদীপ্ত সেনের তৈরি সারদা সাম্রাজ্যের চারটি সংস্থা এবং সল্টলেকের এক এজেন্টের বিরুদ্ধে সেটাই ছিল প্রতারণার প্রথম মামলা। সেই মামলাকে সামনে রেখে শুরু হয়েছিল পুলিশি তদন্ত। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে এখন তা সিবিআইয়ের হাতে। পাশাপাশি, ওই কেলেঙ্কারির তদন্ত চালাচ্ছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। সব মিলিয়ে সারদা-কাণ্ড এখন দেশের গণ্ডিও ছাড়িয়েছে।

তিনতলার সেই ঘরে বসে টিভি-র পর্দায় কেলেঙ্কারির ব্যাপ্তি দেখছেন মল্লিকাদেবী। দেখছেন, কী ভাবে

মন্ত্রী-আমলা-ব্যবসায়ী-অভিনেতা-খেলার জগতের চেনাজানা লোকগুলোর নাম জড়িয়ে পড়ছে এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে। “এঁদের দেওয়া হবে বলেই কি আমাদের মতো গরিবদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী! আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্লাবগুলোকেও বিলিয়েছে! গরিব মানুষের কষ্টের টাকা...” আনমনে বলেন মল্লিকা।

এক বারও মনে হয় না, আপনারই করা প্রতারণা মামলার জন্যই এত বড় কেলেঙ্কারির পর্দা ফাঁস হল? মল্লিকা বলেন, “আমার এ সব কিছুই মনে হয় না। সিবিআই, ইডি, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ...এ সব জেনে আমার কী হবে? আমি টাকাটা ফেরত পাব?” বৃহস্পতিবার দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে বসে অনিবার্য প্রশ্নটাই করলেন তিনি। তবে যে দিন শুনলেন সুদীপ্ত সেন ধরা পড়েছেন, সে দিন খুশি হয়েছিলেন। বললেনও সে কথা, “খুব খুশি হয়েছি। ওকে ছাড়লে অন্যায় করা হবে।” তাঁর আগাম হুঁশিয়ারি, “আমাদের টাকা ফেরত দেওয়ার আগে ওকে ছেড়ে দিলে আমি আবার অভিযোগ করব, মামলা করব।”

শুধু তো সুদীপ্ত নয়, একে একে অনেক নামই তো উঠে আসছে! এ বার খানিকটা উত্তেজিত, “তাতেই বা কী হবে? আমি তো বসে আছি কবে টাকা ফেরত পাব।” একটু থেমে বললেন, “শুনছি, এক-এক জন মাসে ১৫-২০ লক্ষ টাকা করে মাইনে পেতেন। সে তো আমাদেরই টাকা! ফুটবল ক্লাবকে টাকা দেওয়া হয়েছে। সে-ও তো আমাদেরই টাকা! ওই লোকগুলোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে কি আমাদের ফেরত দেওয়া হবে?” মল্লিকা থামছেন না, “মেনে নিলাম, যাঁরা এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তাঁরা সমাজের গণ্যমান্য লোক। কিন্তু আমার মতো লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে নয়ছয় করার আগে কী তাঁদের ভাবা উচিত ছিল না!” তাঁর আশঙ্কা, মন্ত্রী-নেতাদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় যে ভাবে জলঘোলা হতে শুরু

করেছে, তাতে তদন্তটাই না মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায়!

মাত্র এক বছরেই সব ওলোটপালট হয়ে গিয়েছে মল্লিকার। জানালেন, ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে দেহরাদুন গিয়েছিলাম। সেখানেই টিভিতে দেখি সারদার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার। সারদার বিরুদ্ধে বেতন না পাওয়ার প্রথম অভিযোগটি পুলিশের কাছে দায়ের করেছেন তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষ। কয়েক জন সারদাকর্মীও সেই অভিযোগ জানিয়েছেন। সব জেনে বুকের ভিতরটা দলা পাঁকিয়ে আসে। তত দিনে ৬ লক্ষ ১৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা ফেলেছি যে।

তড়িঘড়ি কলকাতায় ফেরেন মল্লিকা। যোগাযোগের চেষ্টা করেন সল্টলেকের সেই এজেন্টের সঙ্গে। পাঁচ দিন ঘুরে, তাঁকে না পেয়ে ৬ মে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁর আগেও সল্টলেকের একটি থানায় দুই আমানতকারী অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতারণার অভিযোগ প্রথম করেন মল্লিকাই। সেই লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন সুদীপ্ত-র নামও (যদিও পদবিটা ভুল করে গুপ্ত লিখে ফেলেছিলেন)। এক মাসের মধ্যেই এজেন্ট নরোত্তমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁকে ছেড়েও দেওয়া হয়। মল্লিকার বক্তব্য, “আমাকে তো ওই ছেলেটাই ভুল বুঝিয়ে টাকা নিয়েছিল। সার্টিফিকেটে লেখা ছিল সারদা ট্যুরস। এক দিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমি কি বেড়াতে যাব নাকি! উত্তরে সে বলেছিল, ও সব দেখাতে হয় বৌদি। আসলে আপনার নামে জমির দলিল তৈরি হচ্ছে।” সেই দলিল অবশ্য আজও হাতে পাননি তিনি।

মাঝে একবার থানায় ডেকেছিল তাঁকে। তিনি কাগজপত্র দিয়ে আসেন। সম্প্রতি সিবিআই দফতরেও যেতে হয়েছিল তাঁকে। “কিন্তু কেউ বলতে পারছেন না কবে টাকা ফেরত পাব, অথবা আদৌ পাব কি না”সন্দিগ্ধ মল্লিকা। বললেন, “খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ছুটেছিলেন শ্যামল সেন কমিশনে। সেখানে এক অফিসার জানতে চাইলেন, ‘কত রেখেছিলেন? তার পর টাকার অঙ্ক শুনে বললেন, যেমন দিয়েছিলেন, এখন ঠেলা বুঝুন! টাকা এখন ফেরত পাবেন না।’’

আশা ছাড়লে অবশ্য মল্লিকার চলবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam cbi mallika chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE