মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ও শাসক দল যতই তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাক না কেন, তদন্তে সহায়তা পেলে রাজ্য পুলিশের প্রতি সৌজন্য দেখাতে ত্রুটি রাখবে না জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। খাগড়াগড়-কাণ্ডে তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য ইতিমধ্যেই বর্ধমান জেলা পুলিশের দুই সাব-ইন্সপেক্টর ও তিন কনস্টেবলকে এনআইএ নগদে পুরস্কৃত করেছে। খুব শীঘ্রই মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলা পুলিশের কয়েক জন অফিসার ও কর্মীকে একই ভাবে আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হবে বলে এনআইএ সূত্রের খবর। তা ছাড়া, এ ক্ষেত্রে মালদহ জেলা পুলিশেরও কয়েক জনের কথা ভেবেছেন খাগড়াগড়ের তদন্তকারীরা।
আবার, খাগড়াগড়-কাণ্ডে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত, জঙ্গিদের ‘বর্ধমান মডিউলের আমির’ সাজিদ ওরফে মাসুদ রানাকে ধরে দেওয়ার ইনাম হিসেবে এনআইএ ইতিমধ্যেই বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটকে নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছে। পুলিশ জানায়, বাংলাদেশের নাগরিক সাজিদকে গত ৮ নভেম্বর কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে, যশোহর রোড থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিসেম্বর মাসেই এনআইএ-র কাছ থেকে ইনাম পেয়ে গিয়েছে বিধাননগরের পুলিশ।
এনআইএ-র এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “রাজ্য সরকারের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও নজিরবিহীন ভাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক খাগড়াগড়-কাণ্ডের তদন্তভার আমাদের হাতে দিয়েছে। তদন্তভার নেওয়ার পরেও রাজ্য সরকার ও শাসক দল বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার করেছে। এই অবস্থায় তদন্তে আমাদের সাহায্য করার ব্যাপারে রাজ্য পুলিশের অনেকেরই দ্বিধা, সঙ্কোচ, এমনকী আপত্তিও ছিল।” কিন্তু রাজ্য পুলিশের একাংশ ওই ইতস্তত ভাব ঝেড়ে ফেলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাদের সাহায্য করেছেন বলে এনআইএ-র বক্তব্য। আর সে জন্যই তাঁদের আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।
তদন্তে এনআইএ-কে কী ধরনের সহায়তা করেছেন রাজ্য পুলিশের ওই অফিসার ও কর্মীরা?
এনআইএ সূত্রের খবর, কেউ গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা-তথ্য দিয়েছেন, কেউ মামলার পক্ষে সহায়ক জিনিসপত্র ও নথিপত্র উদ্ধারের কাজে সহযোগিতা করেছেন, আবার কখনও কোনও তল্লাটে তল্লাশি অভিযানের সময়ে রাজ্য পুলিশের কয়েক জন সঙ্গে থাকায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের পক্ষে কাজ করা অনেকটাই সহজ হয়েছে।
সম্প্রতি বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন রাজ্য শিশু সুরক্ষা আয়োগকে চিঠি দিয়ে এনআইএ-তদন্তে শিশু সুরক্ষার অধিকার মারাত্মক ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। বর্ধমানের জেলাশাসকের দাবি, গত ১৬ অক্টোবর বাদশাহি রোডে রেজাউল করিমের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৩৫টি গ্রেনেড ও চারটি সকেট বোমা উদ্ধার করার ক্ষেত্রে এনআইএ এক নাবালককে কাজে লাগিয়েছিল এবং তাকে দিয়ে বোমাভর্তি বস্তা খোলানো হয়েছিল।
এনআইএ-র এক শীর্ষ অফিসারের কথায়, “রাজ্য সরকার ও শাসক দল যেখানে আমাদের বিরোধিতায় নেমেছে, সেই জায়গায় রাজ্য পুলিশের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া কিন্তু খুব সহজ ছিল না। কিন্তু রাজ্য পুলিশের ওই অফিসার ও কর্মীরা রাজনীতির কথা মাথায় রাখেননি এবং তাঁদের যথাযথ কর্তব্য পালন করা থেকে বিচ্যুত হননি।” কেন্দ্রীয় সংস্থার ওই কর্তার বক্তব্য, “খাগড়াগড়ে আমাদের সহায়তা করার জন্য আপাতত বর্ধমান জেলার পাঁচ পুলিশকর্মীকে আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তবে আরও দু’টি জেলার কয়েক জন পুলিশকর্মীও শীঘ্রই একই রকম পুরস্কার পাবেন।”
বর্ধমান জেলা পুলিশের যে পাঁচ জনকে এনআইএ পুরস্কার দিয়েছে, তাঁরা হলেন: দুই সাব-ইন্সপেক্টর পায়েল মজুমদার ও মধুমিলন ভাণ্ডারী এবং তিন কনস্টেবলসব্যসাচী চক্রবর্তী, অভিজিৎ মণ্ডল ও মৃত্যুঞ্জয় মান্না। এসআইদের দু’হাজার ও কনস্টেবলদের হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
খাগড়াগড়-কাণ্ডের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে সহায়তা করার জন্য পুরস্কারের আর্থিকমূল্য এত কম কেন?
এনআইএ-র এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, সরকারি নিয়মবিধিতে ধার্য আর্থিক মূল্য অনুযায়ীই পুরস্কার দেওয়া হয়। এক এক জন সিনিয়র অফিসার এক এক অঙ্কের পুরস্কার দিতে পারেন। যেমন, এসপি পদমর্যাদার কোনও অফিসার কাউকে হাজার টাকা আবার আইজি পদমর্যাদার অফিসার কাউকে দু’হাজার টাকা পুরস্কার দিতে পারেন। প্রসঙ্গত, কলকাতার পুলিশ কমিশনার তিন হাজার টাকা পুরস্কার দিতে পারেন। এনআইএ-র অফিসার জানান, ইংরেজ আমলের দু’টাকা, পাঁচ টাকা, ১০ টাকা থেকে ক্রমশ বাড়তে বাড়তে পুরস্কারের মূল্য এই অঙ্কে এসেছে। যদিও এই মূল্য বর্তমান বাজারদামের তুলনায় নেহাতই অকিঞ্চিৎকর এবং এর সংস্কার অবিলম্বে প্রয়োজন বলে ওই অফিসার মনে করেন।
তবে ওই কেন্দ্রীয় তদন্তকারীর কথায়, “আর্থিক মূল্যের চেয়েও এই ধরনের পুরস্কার গুরুত্বপূর্ণ অন্য কারণে। পুলিশকর্মীর সার্ভিস বুকে ওঠে ওই পুরস্কার। লাল কালি দিয়ে লেখা থাকে। তাই, পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই ধরনের পুরস্কার অনেক সময়েই নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। এক এক অঙ্কের পুরস্কারের পয়েন্ট এক এক রকম।”
তবে খাগড়াগড়-কাণ্ডে অভিযুক্ত জঙ্গি-চাঁই সাজিদের জন্য এনআইএ ১০ লক্ষ টাকা ইনাম ঘোষণা করলেও বিধাননগর কমিশনারেট পাঁচ লক্ষ টাকা পেল কেন? এনআইএ-র এক শীর্ষকর্তা বলেন, “সাজিদকে পেতে যত টাকা ইনাম ঘোষণা করা হয়েছিল, তত টাকাই বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের পাওয়ার কথা। কেন ওঁরা অর্ধেক টাকা পেলেন, সেটা খতিয়ে দেখছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy