Advertisement
E-Paper

শীতল জেদেই ভাড়ার বাড়ি সুদীপ্তের কব্জায়

থাকার জন্য সল্টলেকে নিজের দোতলা বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেনকে। সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার ধীরে ধীরে কী ভাবে সেই বাড়ি কব্জা করলেন, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-কে তা জানিয়ে এসেছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার দীপক সেন। ‘বিনয়ী’ সেই ভাড়াটে সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ তথ্যও তদন্তকারীদের দিয়েছেন ৭৭ বছরের দীপকবাবু।

সুনন্দ ঘোষ ও শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৪ ০৩:৩২

থাকার জন্য সল্টলেকে নিজের দোতলা বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেনকে। সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার ধীরে ধীরে কী ভাবে সেই বাড়ি কব্জা করলেন, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-কে তা জানিয়ে এসেছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার দীপক সেন। ‘বিনয়ী’ সেই ভাড়াটে সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ তথ্যও তদন্তকারীদের দিয়েছেন ৭৭ বছরের দীপকবাবু।

সেই তথ্যের মধ্যে আছে: বাড়ি পাওয়ার জন্য কোনও দিনও হুমকি দেননি সুদীপ্ত। লোক পাঠিয়ে ভয়ও দেখাননি। প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। শুধু বিনয়ের সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় বারবার বলেছেন, ‘এ বাড়ি আমার চাই।’ সেই জেদের সামনে হার মেনে শেষ পর্যন্ত কার্যত জলের দরেই নিজের বাড়ি সুদীপ্তকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন দীপকবাবু।

বাড়িটি আপাতত পুলিশের হেফাজতে। দীপকবাবু ওই বাড়ি বিক্রি বাবদ সুদীপ্তের কাছ থেকে এক কোটি ১৬ লক্ষ টাকার চেক (চার বারে) এবং ন’লক্ষ টাকা নগদ নিয়েছিলেন। সেই সময় সল্টলেকের জমি-বাড়ি হস্তান্তর বেআইনি ছিল। সেখানকার ওই দোতলা বাড়িটি তাই এখনও রয়ে গিয়েছে দীপকবাবুর নামেই। গড়িয়াহাটের বাসিন্দা দীপকবাবুর দাবি, তিন হাজার বর্গফুটের দোতলা বাড়িটির বাজারদর প্রায় তিন কোটি টাকা! কিন্তু সুদীপ্তের জেদের মুখে বাধ্য হয়েই দেড় কোটিতে বিক্রি করে দেন। তার মধ্যে ২৫ লক্ষ টাকার চেক ‘বাউন্স’ করেছে (ফেরত এসেছে)।

বিক্রি না-ও করতে পারতেন! আপনাকে তো জোর করা হয়নি?

ইডি-র জিজ্ঞাসাবাদের মুখে দীপকবাবু বলেন, “বাড়ি বেহাত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। এক সময় বুঝতে পারলাম, সুদীপ্ত ওই বাড়ি ছাড়বেন না। তাই যা দাম পাচ্ছি, তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।” দীপকবাবু ইডি-কে জানান, ২০০৭ সালের আগে সুদীপ্ত যখন নিয়মিত ভাড়া দিতে পারছিলেন না, তখন বেশ কয়েক বার বাড়ি খালি করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতি বারেই ‘ছেড়ে দেব, একটু সময় দিন’ বলে এড়িয়ে যান। ২০০৭-এর পরে সারদার ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। নিয়মিত ভাড়া দিতে শুরু করেন সুদীপ্ত। দীপকবাবু বলেন, “এর পরেও আমি বেশ কয়েক বার বাড়ি ছেড়ে দিতে বলি। তখন সুুদীপ্ত বলতে শুরু করেন, ‘এটা আমার পয়া বাড়ি। এটা আমার চাই।’ আমি ওঁকে বলি, বাড়ি বিক্রি করব না। উনি চুপ করে থাকতেন। কিন্তু বাড়ি ছাড়েননি।”

সুদীপ্তের সঙ্গে এই নিয়ে দীপকবাবুর বাদানুবাদও হয়েছে অনেক বার। দীপকবাবুর কথায়, “প্রতি বারেই আমি ফোনে বা ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে একতরফা চিৎকার করেছি। কিন্তু উনি চুপ করে থেকেছেন।” বাড়ি ফেরত পেতে তৎকালীন বাম সরকারের এক মন্ত্রীরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন দীপকবাবু। কিন্তু সেখানেও বিশেষ আমল পাননি। শেষে তিনি হাল ছেড়ে দেন।

দীপকবাবু জানান, ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে মাসিক ৩০ হাজার টাকায় বাড়িটি ভাড়া নেন সুদীপ্ত। এক দালাল মারফত তাঁর গড়িয়াহাটের বাড়িতে দেখা করতে এসেছিলেন সাধারণ জামাকাপড় পরা সুদীপ্ত। অগ্রিম বাবদ আড়াই লক্ষ টাকাও দেন। কিন্তু বাড়ি ভাড়া নেওয়ার মাস দুয়েক পর থেকেই টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন। ওই সময় বেহালায় সারদার অফিস ও বিষ্ণুপুরের সারদা গার্ডেনে গিয়ে টাকার জন্য বেশ কয়েক বার সুদীপ্তের সঙ্গে দেখা করেছিলেন দীপকবাবু। কিন্তু বাড়ি-ভাড়া দেওয়ার বিষয়ে উচ্চবাচ্য করতেন না সুদীপ্ত। দীপকবাবুর কথায়, “অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করতেন উনি। সরাসরি ‘না’ বলতেন না।” তাঁর বক্তব্য, সুদীপ্ত দীর্ঘ ক্ষণ বসিয়ে রাখতেন। তার পরে ‘আজ আমাকে ক্ষমা করুন’ বলে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অগত্যা ওখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হতেন দীপকবাবু। ২০০০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এ ভাবে নানা অছিলায় এড়িয়ে গিয়েছেন সুদীপ্ত। “তবে কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি,” বললেন বাড়ি খোয়ানো বৃদ্ধ।

দীপকবাবু ইডি অফিসারদের জানান, ২০০৭ সালের পরে সুদীপ্ত আবার ৩০ হাজার টাকা করে ভাড়া দিতে শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, বকেয়া সাড়ে চার লক্ষ টাকাও মাসে মাসে দিয়ে মিটিয়ে দেন। সেই সময় সল্টলেকের ওই বাড়িতে সুদীপ্তের প্রথম স্ত্রী মধুমিতা, ছেলে শুভজিৎ, মেয়ে প্রিয়াঙ্কা, শুভজিতের স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা (ননদ-বৌদির একই নাম) থাকতেন। ২০০৭ সালে জানুয়ারিতে সুদীপ্ত সল্টলেকে নিজের অফিসে দীপকবাবুকে ডেকে পাঠান। দীপকবাবু জানান, দেড় কোটি টাকায় বাড়িটি কিনতে চান সুদীপ্ত। উপায়ান্তর না-দেখে রাজি হয়ে যান দীপকবাবু। এর পরে যত বার তিনি সুদীপ্তের কাছ থেকে চেক নিয়েছেন, তত বারই সেই টাকার একটি বড় অংশ সারদায় রাখার জন্য অনুরোধ করেছেন ওই সংস্থার কর্ণধার। দীপকবাবুর কথায়, “আমি একটি টাকাও সারদায় বিনিয়োগ করিনি। বেশ কয়েক বার আমাকে ওই সংস্থায় ডিরেক্টরের চাকরির প্রস্তাবও দেন সুদীপ্তবাবু। আমি রাজি হইনি।”

দীপকবাবু জানান, চেক দেওয়ার জন্য মাঝরাতেও ডেকে পাঠাতেন সুদীপ্ত। চেক দেওয়ার পরে নিজের গাড়িতে গড়িয়াহাটে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থাও করতেন। দীপকবাবু ইডি অফিসারদের জানান, বাড়ি বিক্রির অর্ধেক টাকা দেওয়ার পরেই ওই বাড়ির দলিলটি তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিলেন সুদীপ্ত।

দীপকবাবুর কথায়, “তত দিনে আমি বুঝে গিয়েছি, রাজনৈতিক ও পুলিশমহলে কতটা যোগাযোগ রয়েছে ওঁর। প্রতিবাদ করে যে আর কোনওই লাভ হবে না, সেটাও বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছিলাম।”

সুদীপ্তের পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, সারদা-প্রধান যে-বাড়িকে এত পয়মন্ত মনে করতেন, সেখানে অবশ্য এক দিনও থাকেননি তিনি। ওই বাড়ি ভাড়া নেওয়ার অনেক আগেই তিনি থাকতে শুরু করেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী পিয়ালির সঙ্গে। সল্টলেকেই ভাড়া নেওয়া অন্য একটি বাড়িতে।

saradha case sunanda ghosh shubhashis ghatak
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy