Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সবই অচেনা হাওয়ার মহিমা

যেন এই মাত্র পুকুরে ডুব দিয়ে উঠলেন তিনি। গা-মাথা বেয়ে জলধারা, গায়ের পাঞ্জাবিটা চিপলে নির্ঘাত একটা মাঝারি বালতি ভর্তি হয়ে যাবে। দু’হাতে ভিড় ঠেলে জি টি রোডের ধারে একটি অফিস ঘরে ঢুকলেন ঘর্মাক্ত কলেবর কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার, বেলা এগারোটা। চাঁপদানির পলতাঘাটে শেষ হল তাঁর সকালের পদযাত্রা। দলীয় নেতা-কর্মীদের দিকে তাকিয়ে তৃণমূল প্রার্থী ঘোষণা করলেন: “আমি আজ খুব খুশি। যা দেখলাম, যা বুঝলাম তাতে আর কোনও ভাবনা নেই। এই জায়গাটা না ঘোরা পর্যন্ত ঠিক স্বস্তি হচ্ছিল না।”

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৩
Share: Save:

যেন এই মাত্র পুকুরে ডুব দিয়ে উঠলেন তিনি। গা-মাথা বেয়ে জলধারা, গায়ের পাঞ্জাবিটা চিপলে নির্ঘাত একটা মাঝারি বালতি ভর্তি হয়ে যাবে। দু’হাতে ভিড় ঠেলে জি টি রোডের ধারে একটি অফিস ঘরে ঢুকলেন ঘর্মাক্ত কলেবর কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার, বেলা এগারোটা। চাঁপদানির পলতাঘাটে শেষ হল তাঁর সকালের পদযাত্রা। দলীয় নেতা-কর্মীদের দিকে তাকিয়ে তৃণমূল প্রার্থী ঘোষণা করলেন: “আমি আজ খুব খুশি। যা দেখলাম, যা বুঝলাম তাতে আর কোনও ভাবনা নেই। এই জায়গাটা না ঘোরা পর্যন্ত ঠিক স্বস্তি হচ্ছিল না।”

চাঁপদানিকে অনায়াসে মিনি ভারত বলা যায়। নানা ভাষা, নানা মত, নানা ধর্মের সহাবস্থান এখানে। মহরমের মিছিল, হনুমানজি-র শোভাযাত্রা সবই জৌলুসময়। তাই হনুমানজি-র ভক্তদের সমর্থন আদায় করা কল্যাণের কাছে যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ দখলে রাখা।

চাঁপদানি পুরসভা এখন তৃণমূলের দখলে। তবুও বিজেপি ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে, এমন সম্ভাবনার মুখে শিথিলতা রাখতে রাজি নন তৃণমূল প্রার্থী। তিন ঘণ্টার গলদঘর্ম কর্মসূচিতে সেই কাজটিই সারলেন তিনি। সামান্য নাকে-মুখে গুঁজে এ বার তাঁকে ছুটতে হবে জগৎবল্লভপুর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেলিকপ্টার একটু পরেই নেমে পড়বে সেখানে।

কিন্তু বিজেপি নিয়ে এত আলোচনার বাজারে তাদের তারকা প্রার্থী বাপ্পি লাহিড়ী কোথায়? বারোটা বাজল। একটা বাজল। দু’টোও বেজে গেল! কখন আসবেন তিনি? শ্রীরামপুরে দিল্লি রোডের উপরে একটি বড় হোটেল তাঁর বিশ্রামের ঠিকানা। পরিবার এবং পার্ষদ, সকলের সুবিধার্থে সেখানে কয়েকটি ঘর নিয়ে রেখেছেন এই ভোট-ভিক্ষু। রোজই কলকাতার অন্য একটি হোটেল থেকে এই হোটেলে পৌঁছে তার পর শুরু হয় তাঁর ভোট-প্রচার। কোন দিন কোথায় যাবেন, সেটাও স্থির হয় তিনি পৌঁছনোর পরে। সঠিক হদিস দেওয়ার মতো লোকজনের বড়ই অভাব!

বাপ্পির জামাই গোবিন্দ বনশল অবশ্য অতি সৌজন্যে হোটেলের একটি ঘর খুলিয়ে বসতে দিলেন। ঠান্ডা ঘরে আরও ঘণ্টা দু’য়েকের প্রতীক্ষা। বাপ্পি লাহিড়ী ঢুকলেন বিকেল পৌনে চারটেয়। চোখেমুখে শ্রান্তি বোঝা গেল না। বরং এক রাশ হাসি, মজা শো-ম্যানশিপে যা দেখা যায়! এত দেরি? বাপ্পি বললেন,“বালির লাগোয়া কিছু এলাকায় প্রচার সেরে এলাম।”

খাওয়াদাওয়া সেরে, গেরুয়া পাঞ্জাবি, তেরঙা উত্তরীয়তে বিজেপি-প্রার্থী বিকেলের প্রচারে বেরোলেন সওয়া পাঁচটায়। প্রথম গন্তব্য কোন্নগর। চার গাড়ির কনভয়। সঙ্গে দলের লোক জন খুব বেশি নেই। আছেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, ব্যক্তিগত সহকারী এবং নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা। দিল্লি রোড থেকে বাঁক নিয়ে নৈটি রোড। কনভয় থামল কানাইপুরে। তাঁকে দেখতে গাড়ি ঘিরে পাড়ার ছেলে-বউদের জটলা। বাপ্পি লাহিড়ী গাড়িতে বসেই হাসি মুখে হাত তুলছেন বার বার। পাশে চলছে তাঁকে গাড়ি থেকে নামানোর আয়োজন। আয়োজন মানে, একটি চাঁদোয়া ঢাকা ছোট লরিতে মজবুত কাঠের সিঁড়ি লাগানোর পর্ব। সবটাই ওজন অনুযায়ী তৈরি করা। তাঁর কনভয়ের সঙ্গেই থাকে। সিঁড়ি বেয়ে দু’এক ধাপ উঠে মাইক ধরে বাপ্পি লাহিড়ী ভিড়ের উদ্দেশে বললেন, মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গেই তিনি যদি এই কেন্দ্রে বিজেপি-র সাংসদ হতে পারেন, তা হলে শ্রীরামপুরে উন্নয়নের বন্যা বইবে। নইলে কিছুই হবে না। ‘চিরদিনই তুমি যে আমার....’ গেয়ে ভাষণ শেষ হয়।

কী বুঝছেন, জিতবেন? বাপ্পি বলেন, “লোকে ভালবাসছে, সেটাই আসল। হার-জিত তো ভগবানের হাতে। আমার প্রথম ছবি ‘জখমি’ থেকে শুরু করে আজকের ‘উ লা লা’ সব গান মানুষের মনে। আর কী চাই!” সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, “মোদীজি শ্রীরামপুরকেই সভার জন্য বেছে নিয়েছেন, কেন? কারণ, এই কেন্দ্রে বিজেপি-র সম্ভাবনা উজ্জ্বল।”

সম্ভাবনার এই তত্ত্বটা অঙ্কের হিসেবে মেলানো কিছুটা কঠিন। কারণ, গত লোকসভা ভোটে সিপিএমকে ১ লক্ষ ৩৭ হাজারে হারিয়ে জিতেছিলেন কল্যাণ। বিজেপি পেয়েছিল ৩৭ হাজারের কিছু বেশি। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের বিচারে ব্যবধান আরও বেড়েছে। তৃণমূলের হাতে এসেছে কয়েকটি পুরসভাও। এলাকায় তৃণমূলের উপস্থিতি, প্রভাব এবং প্রচারের বহর কিছুই কম নয়। তবু অচেনা হাওয়ার অজানা হল্কাই হয়তো কল্যাণের গায়ের ঘাম শুকোতে দিচ্ছে না।

সাধারণত যা যা ঘটলে এক জন নির্বাচিত সাংসদ তাঁর সমর্থনের ভিতে ফাটলের ভয় পান, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে আপাত ভাবে তার অনেক কিছুই খাটে না। নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। সাংসদ তহবিলের টাকায় বিস্তর কাজ করেছেন। স্থানীয় নেতাদের গুরুত্ব দিয়েছেন। মোটামুটি মসৃণ একটি দলীয় সংগঠনও তাঁর পাশে আছে। এমনকী, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্ব্যবহারের অভিযোগ জোর গলায় নস্যাৎ করে দিতে সদা তৎপর কল্যাণের দলীয় সহকর্মীরা। তবু কল্যাণের বক্তব্য: “আমি কোথাও কোনও চান্স নিচ্ছি না। সব আঁটঘাট বেঁধে রাখছি।”

অবাঙালি এলাকার মন কাড়তে ভোজপুরি গায়ক কালুয়াকে উড়িয়ে আনা হচ্ছে এখানে। তাঁর গানের ফাঁকে ফাঁকে চলবে তৃণমূল প্রার্থীর জন্য ভোটের আবেদন। প্রচারের শেষ বেলায় মুম্বই থেকে মহিমা চৌধুরীকে নিয়ে এসে পদযাত্রার ভাবনাও চলছে। তালিকায় আছেন পদ্মিনী কোলহাপুরী।

বাপ্পি লাহিড়ী এত ভারী! শুধু তা কেন? কংগ্রেসের পুরনো নেতা আব্দুল মান্নানও তো বলছেন, তিনি সাড়ে তিন লাখ ভোট পাবেনই এবং তাতে অন্তত কল্যাণের পরাজয় নিশ্চিত! কথাটা পাড়তেই ‘হো হো’ করে লুটিয়ে পড়লেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী, বৈদ্যবাটির পুর-প্রধান অজয়প্রতাপ সিংহ আত্মপরিচয়ে যিনি ‘কল্যাণদার জামার বোতাম’। অতঃপর তাঁর মন্তব্য: “দাদা, এমন অট্টহাসিতেও কি বিধিভঙ্গ হয়!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE