Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Russian Revolution

সোভিয়েত বিপ্লবের শতবর্ষ ও সাহিত্য

রাশিয়া থেকে এই বাংলা, সাহিত্যে রুশ বিপ্লবের সগর্ব উপস্থিতি। লিখছেন কিন্নর রায়রাশিয়া থেকে এই বাংলা, সাহিত্যে রুশ বিপ্লবের সগর্ব উপস্থিতি। লিখছেন কিন্নর রায়

রুশ বিপ্লব।

রুশ বিপ্লব।

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৭ ১৭:৫৫
Share: Save:

‘ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার ও তুফান

প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল

কমরেড লেনিনের আহ্বান

চলে মুক্তি সেনাদল...’

‘থ্রু দ্য উইন্টার্স কোল্ড অ্যান্ড ফেমিন

ফ্রম দ্য ফিল্ডস অফ কমরেড লেনিন

দেয়ার আর রোজ অফ পার্টিজান’

এই গান গর্জে উঠত সত্তর দশকের বন্দিশালায়। নভেম্বর বিপ্লবের বয়স তখন ৫৬। যদিও যাঁরা এই গান গাইছেন, তাঁদের অনেকের চোখেই তখন সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, ‘সোস্যাল ইমপেরিয়ালিস্ট’। ১৯১৭-র ৭ই নভেম্বর, দুনিয়া কাঁপানো দশদিনের সেই রূপকথা-গাথা। প্যারি কমিউনের পতনের পর মার্কস-এঙ্গেলস-এর স্বপ্নে দেখা সাম্যবাদী সমাজ। মার্কস বলেছিলেন, উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে বিপ্লব হবে। হয়তো জার্মানি, হয়তো ফরাসি দেশে, অথচ বিপ্লব হল জার শাসিত ক্ষমতাবান কুলাকদের ভূমিতে, ক্ষমতাবান ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন, লিও ট্রটস্কি আর জোসেফ স্তালিনের নেতৃত্বে। নতুন ইতিহাসের নবোদিত পাতায় পাতায় লেখা হল, ‘তামাম ক্ষমতা সোভিয়েতের’। সি পি এস ইউ (বলশেভিক), করেনস্কির সরকার, মেনশেভিক ডুমা, লাল অরোরার কামান, রাসপুটিন, জার নিকোলাস— সব নাম ঘুরে ফিরে আসতে লাগল ঐতিহাসিকতার ক্ষণ জাগরণ, ক্ষণ নিদ্রা মুহূর্তে।

আজ বহু বছর সোভিয়েত নেই। কাচের বাক্সে তবু সদা জাগ্রত, প্রায় মমি মণ্ডিত লেনিন।

মনে কি পড়ে ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’–এর স্মৃতি ? আইজেনস্টাইনের সেই মহাকাব্য? শীতপ্রাসাদ দখলের নিরবিচ্ছিন্ন রক্ত গাথা? ১৯০৫-এর ব্যর্থ অভ্যুত্থান, ১৯১৭-র ৭ নভেম্বরের সফল বিপ্লব, যদিও পুরনো ক্যালেন্ডারের হিসাবে তা ছিল অক্টোবর রেভলিউশন। তার অভিঘাত ছড়াল সমস্ত বিশ্ব জুড়ে।

রুশ বিপ্লব। ছবি : থটকো

অক্টোবর অথবা নভেম্বর বিপ্লবের বিশ্বাসী আলোয় তৈরি হতে থাকল কত কত নবীন সাহিত্য, সিনেমা। এই সব শিল্পকর্মই যে খুব মান-উত্তীর্ণ, তা হয়তো বলা যাবে না। যেমন কি না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সে দেশের গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, চলচ্চিত্র, তুলনাটা খুব যে জুতের হল তা নয়। কারণ অক্টোবর অথবা নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব সমস্ত দুনিয়া জুড়ে। আজও তার প্রভাবকে শতবর্ষ অতিক্রান্ত সময়ে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বিপ্লবের কবি মায়াকোভস্কি ১৯২৩-এর ৪ অগস্ট তাঁর একটি শিরোনামহীন কবিতায় লেখেন,

‘whose hearts

Been washed by October storms

Won’t need

either sunsets

or roaring oceans

Won’t need climatic

or natural charms

nothing at all,

But you- revolution’

এই মায়াকোভস্কি কেন যে আত্মহত্যা করলেন পিস্তলের গুলিতে— উত্তর পাইনি, আজও পাই না। সেখানেও, এই আত্মহননের পেছনেও কি খেলা করে কোনও জীবনানন্দীয় বোধ? জানি না!

‘ঝড়ের পাখি’ ম্যাক্সিম গোর্কির ‘পৃথিবীর পথে’, ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’, ‘ইতালির রূপকথা’ আমরা অনেকেই পড়েছি। বঙ্গানুবাদে যে নামগুলি মস্কোর প্রগ্রেস পাবলিশার্স, জগতি প্রকাশনের বই হিসাবে ভেসে উঠত, তার সঙ্গে সঙ্গে আরও উজ্জ্বলতর কোনও বিপ্লবী সাহিত্য মায়া হিসাবে ভেসে উঠত ‘মাদার’– ‘মা’। বিপ্লবী শ্রমিক পাভেল ভ্লাসব, তাঁর মা পেলাগেয়া নিলভ্না, যিনি তাঁর নৃশংস স্বামীর হাতে প্রায়শই প্রহৃত হতেন, আর এই অত্যাচারী পুরুষটি পেলেগেয়া নিলভনাকে সম্বোধন করত ‘কুত্তি’ বলে। এই চরিত্রটি ম্যাক্সিম গোর্কি নির্মাণ করেছিলেন শ্রমিক নেতা পিওতর জালোমভের মা আন্না কিরিলোভনা জালোসভার আদর্শে, ‘মা’ উপন্যাসটি বঙ্গানুবাদে পড়ি।

এই গোর্কিকে কেন বিপ্লব-উত্তর সোভিয়েত ভূমির সাখালিন দ্বীপে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনবাসে থাকতে হয়েছিল আর কেনই বা স্বয়ং লেনিন গিয়েছিলেন তাঁকে এই স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে বের করে আনতে, তা আজও আমাদের কাছে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দায়িত্ব ও অভিভাবকত্বকে চিহ্নিত করে দেয়। গোর্কিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল, এমন একটা তথ্য সত্তর দশকে ‘কালপুরুষ’ পত্রিকায় পড়েছিলাম।

বরিস পাস্তেরনাকের ‘ডক্টর জিভাগো’, যার জন্য নোবেল জুটেছিল বরিস পাস্তেরনাকের বরাতে, সেই ‘ডক্টর জিভাগো’-তে ১৯১৭-র সোভিয়েত বিপ্লবের কিছু সমালোচনা আমাদের সামনে উঠে আসে।

‘ডক্টর জিভাগো’ এই চলচ্চিত্র ওমর শরিফ ছিলেন। ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন কন্যা। বিস্তৃত রক্ত পতাকা, দুর্ভিক্ষ, কশাকদের ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাওয়া, প্রবল ঠাণ্ডায় মৃত ঘোড়া, বরফের ভাস্কর্যে জমাট ঘরবাড়ির ছাদ, সব কেমন এক সুরে বাজে, বাজতেই থাকে। প্রশ্ন ওঠে ক্ষমতার ভারী থাবা, আস্ফালন কি বদলে দেয় সমস্ত হিসাব-নিকাশ!

অথচ নিকোলাই অন্ত্রোভস্কি ‘হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেমপারড’ যখন লেখেন, বাংলা অনুবাদে ইস্পাত নামের বই হিসাবে তাকে আমরা পাঠ করি নভেম্বর বিপ্লবের অগ্নিস্পর্শ স্মৃতি বুকে, হাতে, বিশ্বাসে আর দু-চোখে ছুঁইয়ে দেওয়ার জন্য। ‘মা’ লেখা হয়েছে বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার পটভূমিতে। ইস্পাত-ও তাই।

জন রিড তাঁর ‘টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড’ বঙ্গানুবাদে ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ যা প্রকাশিত হয় ১৯১৯-এ, তাতে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকদের জার শাসিত রাশিয়ার ক্ষমতা দখলের এক বিস্তৃত বিবরণ আছে। সত্তর দশকে নকশালবাড়ির রাজনীতিতে বিশ্বাসী বহু যুব-ছাত্রের কাছে নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির ‘ইস্পাত’, জন রিডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’, সেই সঙ্গে যোসেফ স্তালিনের লেখা ‘হিস্ট্রি অফ সি পি এস ইউ’ যা অনুবাদ করেছিলেন বিশিষ্ট চিন্তক, লেখক, বাগ্মী ও বিখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বঙ্গানুবাদে গ্রন্থটির নাম সম্ভবত ‘বলশেভিক পার্টির ইতিহাস’। সেই সঙ্গে লেনিনের ‘কী করিতে হইবে’, ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’, ‘মার্কসের পুঁজি’, এমিল বার্নসের ‘মার্কসবাদ’— এ সবই পাঠ্য ছিল।

কবি মায়াকোভস্কির একটি কবিতায় পাচ্ছি–

‘ Lenin –

Lived

Lenin –

Lives

Lenin-

Will always live

Lenin

is graeter

than all of the great,

yet even this wonder of might

mites of all times

amassed to create—

we,

all together,

midget and mite

knot up your muscles

tight

Let inquisitive youngsters

Teeth

The granaite of knowledge

Cleaue.

Lenin –

Lived

Lenin -

Lives

Lenin -

Will always live.

এই কবিতা ১৯২৪-এর ৩১ মার্চ লেখা। তখনও নভেম্বরের মহাক্রান্তি ও তার অন্যতম নেতা লেনিন প্রায় সমার্থক। এক বিন্দুতে বাঁধা।

ল্যাংস্টন হিউজের কবিতাতেও পাই ঝড়তোলা জঙ্গি মজদুরদের কথা। আমাদের দেশের সাহিত্যেও অক্টোবর অথবা নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব বিস্তৃত। জনজীবনে, আন্দোলনে, সাহিত্যে তার প্রভাব অনেক-অনেক দূর পৌঁছেছিল।

রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’, যেখানে তিনি সোভিয়েত ভ্রমণকে প্রায় স্বর্গদর্শনের সমতুল্য বলেছেন। আবার একই সঙ্গে সোভিয়েত ব্যবস্থার অতি আঁটসাঁট দশার দীর্ঘ স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেছেন। শিবরাম চক্রবর্তীর ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী’-র কথাও এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। গোপাল হালদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, সাবিত্রী রায়, মণিকুন্তলা সেন, গোলাম কুদ্দুস, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ বহু জনের গল্প, কবিতায় দীর্ঘ আখ্যান, দিনলিপিতে সোভিয়েত বিপ্লব সগর্বে উপস্থিত। এর বাইরেও আছেন অনেকে। বাংলা ভাষা ছাড়াও সর্বভারতীয় ভাষাতেও বড়সড় প্রভাব পড়েছে ‘অকতুবর ক্রান্তি’র- রুশ মহাক্রান্তির। এই স্বল্প পরিসরে সেই আলোচনা সম্ভব নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Russian Revolution Russia International
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE