Advertisement
০৭ মে ২০২৪
International

কলকাতা থেকে আমেরিকা এসে চমকে যাচ্ছি, ভোট এ ভাবেও হয় তবে!

ভোট জ্বর তো বাড়াবাড়ি। ভোট-ফুস্কুড়িও যে বলা যাবে না একে। যে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা ভারতের যে কোনও নির্বাচনের আগে, যুযুধান দলের সমর্থক-কর্মীদের রক্তে ঢেউ তোলে, ভোটারদের উস্কে দেয়, রাজনীতি বিমুখ মানুষকেও কৌতূহলী করে তোলে, আমেরিকায় এসে দেখি তার ছিটেফোঁটাও নেই।

প্রভাব পড়েনি নিউ ইয়র্কের স্বাভাবিক জীবনে।

প্রভাব পড়েনি নিউ ইয়র্কের স্বাভাবিক জীবনে।

প্রসেনজিৎ সিংহ, ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভ্যানিয়া
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ১৩:১৫
Share: Save:

ভোট জ্বর তো বাড়াবাড়ি। ভোট-ফুস্কুড়িও যে বলা যাবে না একে।

যে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা ভারতের যে কোনও নির্বাচনের আগে, যুযুধান দলের সমর্থক-কর্মীদের রক্তে ঢেউ তোলে, ভোটারদের উস্কে দেয়, রাজনীতি বিমুখ মানুষকেও কৌতূহলী করে তোলে, আমেরিকায় এসে দেখি তার ছিটেফোঁটাও নেই। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে বোঝার উপায় নেই এই দেশটায় ভোট এসেছে। যে সে ভোট নয়, একেবারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।

মোড়ে মোড়ে সভা নেই। ফুল ভলিউমে বাজানো মাইকের গুঁতো নেই। স্লোগান নেই, মিছিল নেই। সুতলিতে বাঁধা দলীয় পতাকার একমাইল ব্যাপী ঝালর নেই। রং-বেরঙের দেওয়াল লিখন নেই। এসবের সঙ্গে প্রায় সমার্থক হয়ে যাওয়া ভোট-অভিজ্ঞতা যে এখানে এসে রামধাক্কা খাবে তাতে আশ্চর্য কী!

প্রায় মাস দু’য়েকের মধ্যে ফিলাডেলফিয়ায় যেটুকু চোখে পড়েছে তা হল, কোনও কোনও ডেমোক্র্যাট সমর্থকের বাড়ির সামনে এক চিলতে বাগানে বসানো নীল ফেস্টুন। ক্লিন্টন-কেইন প্রচারের লোগো। কয়েক দিন আগে হ্যালোউইন উদ্‌যাপনের দিন দেখা গেল এক মহিলা ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের মুখোশ পরে বাচ্চাদের ক্যান্ডি বিলোচ্ছেন। ট্রাম্পের ছবি আঁকা টি-শার্ট পরা এক যুবককে দৌড়তে দেখা গেল সকালের জগিংয়ে।

তবে শেষ পর্যন্ত ভোট মানে সেই প্রতিপক্ষকে টপকে যাওয়ার লড়াই। সে লড়াই বাদ দিয়ে যদি কোথাও ভোট হয়, তবে তা নেহাতই একপেশে, পানসে। আর যাই হোক, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অন্তত সেই দোষে দুষ্ট নয়। কোনও ভাবেই। তা হলে উত্তেজনার সেই ঢেউ কোথায়?

সমস্তই কি দেশটা কম্পিউটারে ভরে ফেলেছে? টিভি চ্যানেলে আটকে রেখেছে?

ধারণাটা আংশিক সত্য। কারণ নির্বাচনী সভা করে প্রার্থীরা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সভাগুলিতে সমর্থকদের ভিড়ও হচ্ছে যথেষ্ট। এমনকী সেই সভায় প্রতিপক্ষকে তুলোধনা করতে ছাড়ছেন না ট্রাম্প বা হিলারি কেউই। তবে সেই ভিড় নিয়ন্ত্রিত। উচ্ছ্বাস সংযত। আম আমেরিকাবাসী এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে ‘ভারচুয়ালি’।

সবটাই দেখা যাচ্ছে পর্দায়। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষের উত্তরও আসছে গোলার মত। হিলারির সমর্থকেরা ট্রাম্পের যাবতীয় নারীঘটিত ‘কেচ্ছা কেলেঙ্কারি’ অতীতের দস্তাবেজ খুঁজে বের করে আনছেন। কখনও ছবি কখনও ভিডিও। তাঁর সম্পদ নিয়েও কম কটাক্ষ হচ্ছে না। হিলারিকে তো দুর্নীতিগ্রস্ত পর্যন্ত বলতে ছাড়ছেন না ট্রাম্প। এই কাদা ছোড়াছুড়ি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে এবারের ভোটকে সবচেয়ে ‘নেগেটিভ ক্যামপেনে’র তকমা দিয়েছেন রাজনীতি চর্চার মানুষজন।

তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চর্চা এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ‘আর্লি ভোটিং’ ঘিরে। শোনা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে প্রায় আড়াই কোটি ‘আর্লি ভোট’ পড়ে গিয়েছে।

অক্টোবরের ২৪ তারিখ থেকে আর্লি ভোটিং শুরু হয়েছে। শেষ হবে ৪ নভেম্বর। এই আগাম ভোটের প্রায় অন্তিম পর্বে কয়েকটা জিনিস লক্ষ করা গেল এবার। আর্লি ভোটারের সংখ্যা ২০১২ সালের নির্বাচনের দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। আর একটা অবশ্যই, এই আর্লি ভোটারদের মধ্যে আফ্রো-আমেরিকানদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাওয়া। সংশয় রয়েছে অন্য একটা বিষয়ও। আর্লি ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোট পাল্টানোর বিষয় চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে। হিলারি শিবিরের কপালে ভাঁজ ফেলেছে ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগ্‌ল। মার্কিন সংস্থাটি সূত্রে খবর, গত কয়েক দিনে ‘কী ভাবে আমি আমার ভোট পাল্টাতে পারি’— এই মর্মে লক্ষ লক্ষ সার্চ করা হয়েছে।

ভারতে নির্বাচনে যেমন পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা থাকে এই আর্লি ভোটিং খানিকটা সেরকমই। তবে পুরোপুরি এক নয়। যেমন, এক্ষেত্রে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে অধিকার প্রয়োগ করে আসতে হয়। অনেক সময় ব্যক্তিগত কারণে অথবা নির্বাচনের দিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে— এসব ভেবে অনেকে নির্ধারিত দিনের আগেই ভোট দিয়ে আসেন। এবার তাহলে কী এমন ঘটল, যে দ্বিগুণ সংখ্যক ভোটারকে আগেভাগেই তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে হল?

আগাম ভোটের ধরন কি এবারের নির্বাচনের ফলাফলে কোনও আগাম ইঙ্গিত দিচ্ছে? খুব নিশ্চিত করে হয়তো কিছু বলা যাবে না। কিন্তু এই আগাম ভোটের হার বৃদ্ধির বাজারে আফ্রো-আমেরিকানদের সংখ্যা কমে যাওয়াটা তাতপর্যপূর্ণ। অনেকেই বলছেন, ওবামাকে হোয়াইট হাউসে পাঠাতে তাদের মধ্যে যে উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, এবারে ‘আর্লি ভোটিং’য়ে অন্তত সেই উৎসাহ নেই। তবে কি হিলারির উদ্বেগ বাড়ল?


ক্লিন্টনের মুখোশ পরে বাচ্চাদের ক্যান্ডি বিতরণ। নিজস্ব চিত্র।

সমীক্ষাগুলো অবশ্য তেমন কথা বলছে না। নতুন করে এফবিআই হিলারির ইমেল নিয়ে তদন্ত শুরু করার পরেও না। অধিকাংশ সংস্থাই এগিয়ে রেখেছে হিলারিকে। তদন্ত সংস্থার নির্দেশের পরে যেরকম খুশির হাওয়া বইতে শুরু করেছিল ট্রাম্প শিবিরে তা হিলারির পালেই না লেগে যায়! ওই তদন্ত কোনও ভাবেই ৮ নভেম্বর, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে শেষ হবে না। অতএব হিলারিকে বেশি অস্বস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। হলে কী হতো তা অবশ্য গবেষণার বিষয়।

আমেরিকার প্রথম নির্বাচিত মহিলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ কি তবে হিলারি অনেকটাই পরিস্কার করে ফেললেন?

বাকি আর মাত্র দিন পাঁচেক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষবেলায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টন আর রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশলের বুনোট আরও মিহি হয়ে এসেছে। প্রচারের কৌশলে একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার এখন শেষ চেষ্টা। এই পর্বের লড়াইটা অনেকটা ভাংচি দেওয়ার মতো। বিয়েবাড়ির কেনাকাটা শেষ। বাড়িভাড়া হয়ে গিয়েছে, লোকজন নিমন্ত্রণ হয়ে গিয়েছে, এমন সময় শোনা গেল পাত্রের নাকি আরও একবার বিয়ে হয়েছিল। ব্যাস, দুধে পড়ে গেল চোনা। হিলারি-ট্রাম্প এখন বোধহয় সেই চোনা গুলে দেওয়ার খেলায় মেতেছেন। অর্থাৎ একে অন্যের শক্ত ঘাঁটিতে আঘাত হানছেন।

যেমন বুধবার হিলারি গিয়েছিলেন অ্যারিজোনায়। অনেকের ধারণা, হিলারির সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য, সেখানকার হিস্প্যানিক ভোটারদের উপর ট্রাম্পের প্রভাব কিছুটা হলেও যদি খর্ব করা যায়! আবার বুধবার ট্রাম্প ছুঁয়ে গেলেন ফ্লোরিডার তিনটি জায়গা।

ফ্লোরিডা গত দু’টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদেরই সঙ্গে ছিল। সেই সমর্থনের ভিত্তি কি এবার ট্রাম্প ভাঙতে পারবেন? ২০০৪ এবং ২০০০ সালের নির্বাচনে এখানকার ভোটারেরা রিপাবলিকানদেরই জিতিয়েছিল। ফ্লোরিডাও এবারের নির্বাচনে ‘সুইং স্টেট’গুলির অন্যতম। এখানকার ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা (২৯) যে কোনও প্রার্থীরই নজর কাড়বে। আর্লি ভোটের নিরিখে এখানে কিন্তু এবার হিলারি পিছিয়েই রয়েছেন।

শুধু তো ফ্লোরিডা নয়, এরকম আরও কয়েকটি রাজ্য রয়েছে যেগুলিকে ‘স্যুইং স্টেট’বলা হচ্ছে, যেমন নর্থ ক্যারোলাইনা (১৫), ওহায়ো (১৮), পেনসিলভ্যানিয়া (২০), অ্যারিজোনা(১১), নেভাদা (৬), আইওয়া(৬)। এগুলির ভোট কার পক্ষে যায়, তার উপরেই অনেকটা নির্ভর করবে এবারের ফলাফল। আগাম ভোটের নিরিখে ট্রাম্প এগিয়ে রয়েছেন অ্যরিজোনা এবং ওহায়োয়। হিলারির পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে নর্থ ক্যারোলাইনা, কলরাডো, নেভাদা, আইওয়ায়।

এবারে ‘আর্লি ভোটে’র বাড়াবাড়ি দেখে অনেকে মনে করছেন, ৮ নভেম্বর অপেক্ষাকৃত কম ভোটারকেই দেখা যাবে বিভিন্ন বুথে। সেটাই বা কীসের ইঙ্গিত? সমীক্ষা যা-ই বলুক, লড়াইটা কিন্তু আর সহজ নয় কারও কাছেই। না হিলারি, না ট্রাম্প।

আরও পড়ুন:
অশনি সঙ্কেত নানাবিধ, হিলারি তবু অনড়ই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Donald Trump Hillary Clinton
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE