স্বদেশে সন্ত্রাস। তাই টিনটিনের চোখেও জল। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
ধরা পড়ার পরই সে জানিয়েছিল, ব্রাসেলসে সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা করার ছক ছিল তাদের। চার মাস লুকিয়ে থাকার পর বেলজিয়ামের রাজধানী থেকে শুক্রবারই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল প্যারিস হামলার মূল চক্রী সালাহ আবদেসলামকে। তিন দিন পেরোতে না পেরোতেই ফলে গেল হুমকি। পরপর তিন বিস্ফোরণে মঙ্গলবার লন্ডভন্ড হয়ে গেল ইউরোপের ‘ককপিট’।
তবে কি এটা জঙ্গিদের প্রতিশোধ? আবদেসলাম যে শহরের কথা বলেছিল, আজ সেটাই আক্রান্ত। তা-ও আবার তার ধরা পড়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে! সঙ্গী গ্রেফতারের বদলাতেই কি আঘাতের খাঁড়া নেমে এল এত তাড়াতাড়ি?
এমনিতে গত বছর প্যারিস হামলার পর থেকে বেলজিয়ামে জঙ্গি হানার সতর্কতা ছিলই। শুক্রবার আবদেসলাম ধরা পড়ার পর তার আইনজীবী দাবি করেন, মক্কেল প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। ফলে পুরনো সঙ্গীদের নামধাম যে অচিরে প্রকাশ হয়ে যাবে, সেই আশঙ্কা হয়তো জঙ্গিদলেরও ছিল। তল্লাশি আরও বাড়ার আগে তারা ফের ইউরোপের কোনও শহরে হামলা চালাবে, আশঙ্কা ছিল গোয়েন্দাদের। আজ যে ভাবে জনবহুল বিমানবন্দর বা মেট্রো স্টেশনকে নিশানা করা হয়েছে— তাতে আবদেসলাম ধরা পড়ার সঙ্গে এ দিনের হামলার যোগকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বিস্ফোরণের দায় স্বীকারও করে নিয়েছে আইএস জঙ্গিরা। ব্রাসেলস
যে ভাবে গত কয়েক বছর ধরে আইএসের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে, সন্দেহের তালিকায় তারাই ছিল সব চেয়ে উপরে।
পশ্চিম ইউরোপের ছোট্ট শহর ব্রাসেলসের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে ইউরোপের যে কোনও বড় শহর থেকে সেখানে পৌঁছনো যায় খুব সহজে। প্যারিস হোক বা আমস্টারডাম, ফ্রাঙ্কফুর্ট, বার্লিন— গাড়ি অথবা ট্রেনে চেপে বেলজিয়ামের রাজধানীতে পৌঁছতে লাগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। আর ইউরোপের এই বিশেষ অবস্থানটাই এখন কাজে লাগাচ্ছে জঙ্গিরা।
তবে শুধু ভৌগোলিক সুবিধার জন্যই নয়, বেলজিয়ামে জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্তের জন্য দায়ী সেখানকার নিরাপত্তার ফস্কা গেরোও। এমনকী এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। তার উপর এখন আবার যোগ হয়েছে আইএসে নাম লেখানোর হিড়িক। শুধু সরকারি হিসেবই বলছে, ২০১২ থেকে প্রায় ৫০০ মহিলা ও পুরুষ বেলজিয়াম ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন সিরিয়া বা ইরাকে। ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় যা বেশ বেশি।
ব্রাসেলসের শহরতলি মোলেনবিক যে আপাতত আইএসের শক্ত ঘাঁটি, তা মানছে বেলজিয়াম প্রশাসনও। প্যারিস হামলার চক্রী আবদেসলাম গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ছিল এখানেই। গত শুক্রবার মোলেনবিকের একটি বাড়ি থেকেই পুলিশ তাকে ধরে। আজ যে মেট্রো স্টেশনে হামলা হয়েছে, সেই মালবিক এই মোলেনবিক থেকে মোটে ৬টি স্টেশন দূরে।
মূলত কয়েক প্রজন্ম আগে উত্তর আফ্রিকা থেকে চলে আসা বহু শরণার্থী পরিবারের বাস এই শহরে। এখানকার নতুন প্রজন্ম যে বেলজিয়াম ছেড়ে ইরাক, সিরিয়ায় ‘ধর্মযুদ্ধে’র তালিম নিতে যাচ্ছে, খোলাখুলি স্বীকার করে নিচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। আর এর জন্য তাঁরা দায়ী করছেন পুলিশের গাফিলতি আর সমাজের কাঠামোকেই। কিছু দিন আগে ছেলেকে হারিয়েছেন হেনেঘেইন। তাঁর কথায়, ‘‘ছেলে যে সিরিয়া চলে যাচ্ছে— আমি নিজে সে কথা থানায় গিয়ে বলে এসেছি। উল্টে শুনতে হয়েছে, যেখানে খুশি যাওয়ার অধিকার রয়েছে তার।’’ ছেলে হারানো মায়ের আক্ষেপ— আইএস দমনে বেলজিয়ান পুলিশের আসলে কোনও ইচ্ছেই নেই। বরং তাদের হাবভাব যেন ‘যেখানে ইচ্ছে যাও, ভুলেও ফিরে এসো না’— ক্ষোভ উগরে দিলেন হেনেঘেইন। তার উপর বর্ণবিদ্বেষ, উদ্বাস্তুদের একঘরে করে রাখা— অভিযোগ অনেক। মোলেনবিকের বাসিন্দাদের দাবি, দেশে কাজ না পেয়ে, বঞ্চনার শিকার হওয়ার থেকে আইএসের যুদ্ধে যাওয়া ভাল বলে মনে করছে তরুণ প্রজন্ম। তাদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর সরকারি উদ্যোগ তো নেই-ই, নেই তাদের ঘরমুখী করার চেষ্টাও।
ফাঁক যে কোথাও রয়েছে, সে কথা মানছে প্রশাসনও। তাই শুধু আইএস দমন করলেই পরিস্থিতিটা পাল্টানো যাবে না। দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনাও দরকার, বলছেন পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ।
যত দিন তা না-হচ্ছে, বধ্যভূমির স্মৃতি ভুলতে পারবে না বেলজিয়াম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy