বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছে গাড়িটা। আর দু’ এক ইঞ্চির এ দিক ও দিক হলেই চরম সর্বনাশ ঘটে যেত। বেশ কয়েক বছর আগে আচমকাই রানির গাড়ির প্রায় গা ঘেঁষেই ভেঙে পড়েছিল একটা বড়সড় আকারের পাথরের চাঁই।
ছবির গ্যালারির অবস্থাও এখন তথৈবচ। একটু বৃষ্টি হলেই বিপত্তি। ছাদ চুঁইয়ে জল পড়তে থাকে। কী করা! অগত্যা ছবি বাঁচাতে ভরসা জলের বালতি। রানির বাথরুমের চিত্রটাও সঙ্গিন। কী সব্বোনেশে কাণ্ড! গত বছর তা মেরামতি করতে গিয়ে বাথরুমের দেওয়ালই একেবারে খসে পড়েছিল। সব মিলিয়ে বাকিংহাম প্যালেসের এখন এমনই করুণ অবস্থা।
বহু জায়গায় ফেটে গিয়েছে জলের পাইপ, বৈদ্যুতিন তার থেকে যে কোনও বড় বিপদ ঘটাও অস্বাভাবিক নয়। ব্রিটিশ সরকার জানিয়েছে, রাজপ্রাসাদের ভিতরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে যে সব বয়লারে জল গরম করা হয়, ফাটল ধরেছে সেখানেও। অতএব খোলনলচে পাল্টে ফেলাই আশু প্রয়োজন। কিন্তু তাতে তো বিরাট অর্থ ব্যয়! সরকারের হিসেবে অন্তত দশ বছর ধরে সারাই করতে হবে রাজপ্রাসাদ। তাতে খরচ নয় নয় করে ৩৬৯০ লক্ষ পাউন্ড। রাজকোষের অবস্থাও তথৈবচ। তা হলে এই বিপুল অর্থ আসবে কোথা থেকে? করদাতাদের গলাতেই কি তা হলে কোপ পড়বে? ব্রিটেন জুড়ে এখন তুঙ্গে এই বিতর্ক।
সপ্তদশ দশকের গোড়ার দিকে তৈরি হয়েছিল প্রাসাদ। আর ১৭৬১ সালে তৃতীয় জর্জ সেটি কেনার পরে রাজপরিবার এখানে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করে। হিসেব অনুযায়ী, রাজপ্রাসাদে ৭৭৫টি ঘর। শৌচাগারের সংখ্যা ৭৮। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, বড় কোনও বিপদ এড়াতে প্রাসাদের মেরামতি আবশ্যক। না হলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে পারে বহু ব্রিটিশ ঐতিহ্য, শিল্পকলা। ঠিক যেমন ১৯৯২ সালে আগুন লাগে উন্ডসর কাসেলে। আর তা সারাতে সময় লেগেছিল পাঁচ বছরেরও বেশি। বাকিংহাম প্যালেসেও তেমন বিপদ ঘটলে মাত্র একটা অংশ সারাতেই এখন খরচ পড়বে আনুমানিক ২৫০০ লক্ষ পাউন্ড। সারাইয়ের সময়ে প্রাসাদেই থাকতে চান নব্বই ছোঁয়া রানি।
তাই কোনও ঝুঁকি নিতে আর রাজি নয় ব্রিটেন সরকার। এ বার প্রায় ১০০ মাইল লম্বা বৈদ্যুতিন তার বদলে ফেলা হবে। সারানো হবে বেশ কিছু মরচে পড়া পাইপও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এত বড় মাপের মেরামিত প্রাসাদে আর হয়নি বলেই জানিয়েছেন সরকারি আধিকারিকরা। আর সে প্রসঙ্গেই প্রশ্ন উঠছে, যদি কিছু সময় পর পর প্রাসাদের দেখভাল করা হতো, তা হলে কি এখন এই বিপুল খরচ পড়ত? এ বিষয়ে অবশ্য সরকারি আধিকারিকদের কাছে তেমন কোনও সদুত্তর মেলেনি। তা ছাড়া এমনিতেই দেশে যথেষ্ট আর্থিক সঙ্কট। ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে করদাতাদের উপরে নতুন করে চাপ তৈরি হলে সেটা কি খুব সহজে মেনে নেবেন দেশবাসী? প্রাসাদ কর্তৃপক্ষ শুধু বলেছেন, ‘‘আশা করছি, দেশবাসীরা হয়তো জাতীয়তাবোধ থেকে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।’’
কিন্তু করদাতাদের টাকায় রাজবাড়ি সারানোর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই অনলাইনে শুরু হয়েছে সই সংগ্রহ অভিযান। যার সংখ্যা ১ লক্ষ ছুঁলেই বিষয়টি পার্লামেন্ট পর্যন্ত গড়াবে। সই অভিযানের নেতৃত্বে থাকা মার্ক জনসন নামে এক প্রাক্তন সাংবাদিক বলছেন, সেই সংখ্যার বেশ কাছাকাছি ক্রমশ পৌঁছে যাচ্ছেন তাঁরা। জনসনের যুক্তি, ‘‘ দেশে যখন বহু মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের অভাব, ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস বা এনএইচএস প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার জোগাড়, তখন সরকার এ রকম পদক্ষেপ করে কী করে?’’ তাঁর দাবি, ‘‘রানির তো প্রচুর সম্পত্তি। তাঁর সিন্দুকের অর্থ থেকেই প্রাসাদ সারানো হোক!’’
রাজপরিবারের যে স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে যেমন বাকিংহাম প্যালেস, উইনসর কাসেল, টাওয়ার অব লন্ডন বা বিভিন্ন পার্ক— তা থেকে পাওয়া রাজস্বের ১৫ শতাংশ প্রতি বছর দেওয়া হতো রানিকে। একেই বলা হয় ‘সভারেন গ্রান্ট’। কিন্তু, এ বার প্রাসাদ সারানোর জন্য ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশ রানিকে দেওয়ার ঘোষণায় অনেকেরই চক্ষু চড়কগাছ। লেবার পার্টির এক সাংসদ হেলেন গুডম্যান যেমন বলেছেন, ‘‘নিম্নবিত্তদের জন্য আবাসন বানানোর খাতে সরকার আর খরচ করছে না। অথচ বাকিংহাম প্যালেসকে এতটা আর্থিক অনুদান দিতে পারছে। কী করে?’’ রাজতন্ত্র বিরোধী গোষ্ঠী রিপাবলিক-এর অনেকেই এই প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন গ্রাহাম স্মিথ। তাঁর কথায়, ‘‘রাজপরিবার যদি নিজেদের বাড়ির খেয়াল নিজেরাই রাখতে না পারে, তবে তাঁদের হাল ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে।’’ বহু বছর ধরে লন্ডনেই থাকেন তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছেন না। তিনি বলেছেন, ‘‘এক জন অভিবাসী হিসেবে আমার মনে হয় বাকিংহাম প্যালেস সারা বিশ্বের কাছে ব্রিটিশ ঐতিহ্যের প্রতীক। তার দেখভালের জন্য এইটুকু খরচ ব্রিটেনবাসী খুশি মনেই মেনে নেবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy