জায়গাটা শহরের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে অন্যতম। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাবুলের সেই জানবাক স্কোয়ারে আজ হামলা চালাল আত্মঘাতী এক জঙ্গি। এত ভয়াবহ বিস্ফোরণ কাবুল শহর শেষ কবে দেখেছে, মনে করতে পারছেন না কেউ। দেশের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই হামলায় মৃত্যু হয়েছে ৯০ জনের। আহত তিনশো ছাড়িয়েছে।
মাঝ সপ্তাহের কাজের দিন। সকাল সাড়ে আটটায় জানবাক স্কোয়ার তখন গাড়ি আর মানুষের ভিড়ে গমগম করছে। আশপাশেই বেশ কয়েকটা দেশের দূতাবাস, দেশের সামরিক দফতর। নিরাপত্তার কড়াকড়ির জন্য জানবাক স্কোয়ারে গাড়ির গতি সব সময়ই শ্লথ থাকে। আচমকাই আকাশ ফাটানো আওয়াজে কেঁপে ওঠে গোটা গ্রিন জোন। ১০০ মিটার দূরের বাড়িতেও ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছে কাচের জানলা।
মুহূর্তে বোঝা যায় ওই ভিড়েই দাঁড়িয়ে থাকা জলের ট্রাকে বিস্ফোরক ঠেসে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছে তার চালক। তত ক্ষণে চিৎকার, আর্তনাদ, রক্তমাখা আতঙ্কিত মুখ আর নিথর লাশের ভিড়ে চেহারা পাল্টে গিয়েছে সদা ব্যস্ত জানবাক স্কোয়ারের। পাশেই পুড়ে খাক কমপক্ষে ৫০টা গাড়ি। আকাশ ঢেকে যায় কালো ধোঁয়ায়। সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা ঘিরে ফেলা হয়। তত ক্ষণে আসতে শুরু করেছে অ্যাম্বুল্যান্স। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর লোকজনও ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে প্রাণের সন্ধান চালাচ্ছেন। বিস্ফোরণের খবর পেয়ে পরিজনের খোঁজে ছুটে আসা স্থানীয় মানুষদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয় ঘটনাস্থলে পৌঁছতে। কাবুলের হাসপাতাল এখন উপচে পড়ছে আহতদের ভিড়ে। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে রক্ত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দেশের সরকার। একটি বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘যে কোনও মুহূর্তে রক্তের সঙ্কট দেখা দিতে পারে’।
আরও পড়ুন: উদ্ধার হল ভেঙে পড়া সুখোইয়ের দুই চালকের দেহাংশ
প্রাণভয়ে: ফের বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাবুলের দূতাবাস এলাকা। হত অন্তত ৯০। জখম তিনশোরও বেশি।
নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই সাধারণ আফগান। ওই এলাকায় অনেকগুলি দেশের দূতাবাস থাকলেও কোনও বিদেশি দূতাবাস কর্মীর হতাহতের খবর নেই। আফগানিস্তানে এই ধরনের হামলায় সবার আগে যাদের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে, সেই তালিবান গোষ্ঠী প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছে এটা তাদের কাজ নয়। জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ নামে তালিবানি মুখপাত্র উল্টে জানিয়েছেন, ওই হামলার কড়া নিন্দা করছে তাদের সংগঠন। মুজাহিদের কথায়, ‘‘এ ভাবে কোনও নিশানা ছাড়া নিরীহ লোককে মেরে ফেলাকে আমাদের গোষ্ঠী মোটেও সমর্থন করে না।’’ দিন কয়েক আগে কাবুলে মার্কিন বাহিনীর একটি গাড়ি লক্ষ করে হামলা চালিয়েছিল ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আইএস। তাতে আট জনের মৃত্যু হয়। সন্দেহের তালিকায় ছিল তারাও। তবে রাতের দিকে আফগান গোয়েন্দা সূত্রে জানানো হয়, পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মদতে হক্কানি গোষ্ঠীই এই হামলা চালিয়েছে। পাক সরকার অবশ্য প্রথমেই গোটা ঘটনার নিন্দা করেছে। বিদেশ দফতরের মুখপাত্র একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, লাগাতার জঙ্গি হানার নিশানায় থাকা তাঁদের দেশ সন্ত্রাসের মর্ম বোঝে।
আজকের হামলার নিশানা আসলে কে বা কারা ছিল, তা স্পষ্ট বলতে পারেননি আফগান পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারাও। হামলাস্থলের কাছেই ফ্রান্স, তুরস্ক আর জার্মানির দূতাবাস। রয়েছে মার্কিন, জাপানি আর ভারতীয় দূতাবাসও। কিন্তু আঁটোসাঁটো নিরাপত্তার জন্য সব দূতাবাসের কর্মীরাই অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। জাপানের তিন দূতাবাস কর্মী আঘাত পেয়েছেন, তবে গুরুতর নয়। মৃত্যু হয়েছে জার্মান দূতাবাসের বাইরে কর্তব্যে থাকা এক আফগান নিরাপত্তারক্ষীর। এক ব্রিটিশ সংবাদ চ্যানেলের আফগান গাড়ির চালকও মারা গিয়েছেন, আহত তাদের চার কর্মী। বিস্ফোরণে খানিকটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত, চিন-সহ কয়েকটি দূতাবাস ভবন।
পবিত্র রমজান মাসে এই হামলার কড়া নিন্দা করেছেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন পোপ ফ্রান্সিসও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও হামলার সমালোচনা করেছেন। আজ সকালে বিস্ফোরণের কিছু পরেই টুইট করেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ‘কাবুল অ্যাটাক’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে তিনি লেখেন, ‘‘ঈশ্বরের কৃপায় ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরা সুরক্ষিত আছেন।’’
জানবাক স্কোয়ারে নিরাপত্তার নিয়ম ভেঙে এত বড় বিস্ফোরক বোঝাই ট্রাক নিয়ে ঢোকার অনমুতি ওই জঙ্গি কী ভাবে জোগাড় করল, তা ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের।