Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
দুই হামলায় বিপর্যস্ত ব্রিটেন

বাঁ হাত ঘেঁষে বেরিয়ে গেল জঙ্গি ভ্যানটা

শনিবারের ঝিরঝিরে বৃষ্টির রাতে বরো মার্কেটের বিভিন্ন বার-এ ভিড় জমেছিল ভালই। টেমসের তিরের কাছে এই মার্কেটে সপ্তাহান্তে তেমনটাই হয়ে থাকে। অনেকে আবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল দেখা শেষ করলেন বারে বসেই। ছুটির এই মেজাজ নষ্ট হয়ে গেল স্রেফ আট মিনিটে। উদ্দাম ভ্যানের গতি আর তার চালকদের ছুরি হাতে বেপরোয়া আক্রমণ।

নিহতদের স্মরণে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাচ্ছেন লন্ডনবাসী। রবিবার লন্ডন ব্রিজের ওপরে।

নিহতদের স্মরণে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাচ্ছেন লন্ডনবাসী। রবিবার লন্ডন ব্রিজের ওপরে।

শ্রাবণী বসু
লন্ডন শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৭ ০৪:১৩
Share: Save:

রাত দশটা নাগাদ উন্মত্ত গতিতে ছুটে আসা সাদা ভ্যানটা চোখে পড়েছিল তাঁরও। অফিসের কাজ চুকিয়ে লন্ডন ব্রিজ ধরে বাড়ির পথে হাঁটছিলেন পেশায় সাংবাদিক আয়ান হাগটন। তাঁর দিকে ধেয়ে আসা ভ্যানকে এড়িয়ে লাফ দিয়ে কোনও মতে পাশে চলে যেতে পেরেছিলেন বলে রক্ষা পেয়েছেন। না হলে যে কী হতো, ৫৫ বছর বয়সি ব্রিটিশ সাংবাদিক আর ভাবতেও পারছেন না!

ঘটনার পরে আয়ান বলছিলেন, ‘‘হঠাৎই দেখি ভীষণ জোরে ছুটে আসছে ভ্যানটা। মানুষ চিৎকার করছে। এ দিক ও দিক ছুটে পালাচ্ছে। তবু ওই ভ্যানের মুখে পড়ে গিয়েছে কেউ কেউ।’’ লন্ডন ব্রিজের অদূরেই দু’টি ব্রিটিশ কাগজের অফিস। স্বভাবতই ওই চত্বরে ছিলেন অনেক সাংবাদিক। আয়ানের কথায়, ‘‘এক বার সরে গিয়েও মনে হলো ফের আমার দিকেই যেন ধেয়ে আসছে ভ্যানটা। পিছিয়ে গেলাম ফুটপাথের দিকে। তখনই বুঝলাম আমার বাঁ হাত ঘেঁষে বেরিয়ে গেল সেটা।’’

পড়ে রয়েছে আততায়ীর দেহ।শনিবার রাতে।

শনিবারের ঝিরঝিরে বৃষ্টির রাতে বরো মার্কেটের বিভিন্ন বার-এ ভিড় জমেছিল ভালই। টেমসের তিরের কাছে এই মার্কেটে সপ্তাহান্তে তেমনটাই হয়ে থাকে। অনেকে আবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল দেখা শেষ করলেন বারে বসেই। ছুটির এই মেজাজ নষ্ট হয়ে গেল স্রেফ আট মিনিটে। উদ্দাম ভ্যানের গতি আর তার চালকদের ছুরি হাতে বেপরোয়া আক্রমণ।

ঘটনার সময়ে লন্ডন ব্রিজের উপরেই ছিলেন আর এক ব্রিটিশ চ্যানেলের সাংবাদিক হলি জোন্স। তিনি বলেন, ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ছুটছিল ভ্যানটা। তাঁর ডান দিক ছুঁয়ে বেরিয়ে যায় ভ্যান। হলি জানান, তাঁর চোখের সামনেই ভ্যানের ধাক্কায় লুটিয়ে পড়েন চার পাঁচ জন।

‘এমার্জেন্সি ব্ল্যাঙ্কেটে’ মুড়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক আক্রান্ত মহিলাকে।শনিবার।

আর এক প্রত্যক্ষদর্শী রবি ছিলেন লন্ডন ব্রিজের উপরে ‘ব্যারোবয় অ্যান্ড ব্যাঙ্কার পাবে’র উল্টো দিকে ট্যাক্সিতে বসে। তিনি বলছেন, ‘‘হঠাৎই দেখি ২০-৩০ জন হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসছেন পাবের দিকে। তখনও জানি না কী হয়েছে। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে দেখি উদ্দাম ভাবে বড় একটা সাদা ভ্যান উল্টো দিকের ফুটপাত ঘেঁষে উঠে যাচ্ছে উপরে।’’ এই পাবের সামনেই থেমে যায় ভ্যানটা। রবির বন্ধু জশ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে আসেন পাব থেকে। তিনি বলেন, ‘‘বরো মার্কেট থেকে দেখলাম লোকজন ছুটছে। এক জন চেঁচাতে চেঁচাতে বলে গেল, ওদের হাতে ছুরি আছে!’’ জেরার্ড নামে এক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, তিনি আততায়ীদের কাছ থেকে দেখেছেন। ‘‘ওরা চিৎকার করে দৌড়চ্ছিল। মুখে বলছিল, সব আল্লার জন্য।’’ জেরার্ড জানান, একটা মেয়ের উপরে অন্তত দশ-পনেরো বার ছুরির আঘাত করেছে ওরা। মেয়েটা অসহায়ের মতো কাঁদছিল। ব্ল্যাক অ্যান্ড ব্লু রেস্তোরাঁয় ছুরি হামলা থেকে বাঁচতে অনেকে আশ্রয় নেন সেখানকার রান্নাঘরে। জেরার্ডের মতো কেউ কেউ আততায়ীদের পিছনে ধাওয়াও করেছিলেন। বোতল, চেয়ার— হাতের কাছে যে যা পেয়েছেন, ছুড়ে মেরেছেন ওদের দিকে।

বারবার ব্রিটেন

• ২২ মার্চ: ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের উপর পথচারীদের ভিড়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকে কয়েক জনকে পিষে দেয় বাহান্ন বছরের খালিদ মাসুদ। এর পর ছুরি হাতে পার্লামেন্টে চত্বরে ঢুকে পড়ে সে। পুলিশ ও আততায়ী-সহ নিহত পাঁচ।

• ২২ মে: মার্কিন পপ স্টার আরিয়ানা গ্রান্ডের অনুষ্ঠান চলাকালীন ম্যাঞ্চেস্টার এরিনায় হামলা চালায় আত্মঘাতী বোমারু সলমন আবেদি। হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। নিহত ২২।

• ৩ জুন: লন্ডন ব্রিজ ও বরো মার্কেট চত্বরে গাড়ি দিয়ে পিষে ও কুপিয়ে সাত জনকে হত্যা করে তিন হামলাকারী।

ঘটনাস্থল থেকে কয়েক মিটার দূরে সেন্ট ক্রিস্টোফারর্স ইন-এ বসে ছিলেন স্টিভেন গিবস। তিনি বলেছেন, একটা কালো ট্যাক্সি ছুটে গেল। শুনলাম কে যেন বলে উঠল, ‘জঙ্গি হামলা হয়েছে। পালাও!’ তার পরেই স্টিভেন উঠে দেখার চেষ্টা করেন কী হচ্ছে। তত ক্ষণে পুলিশের গুলির আওয়াজ আর মানুষের চিৎকার চার দিকে। গিবস আশ্রয় নেন বারের বেসমেন্টে। তত ক্ষণে হুইট্সহিফ পাব-এ গুলি মেরে আততায়ীদের কাবু করে ফেলেছে পুলিশ। আশপাশে অনেক পাবেই আতঙ্ক ছড়ায়। যে যেখানে ছিলেন, প্রত্যেকেই ভেবে নেন, তাঁর পাবেই হামলা হয়েছে। জখমদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে পুলিশকে সাহায্য করেন স্থানীয় লোকজনও।

জিব্রিল পালোম্বা নামে এক ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই আততায়ীদের মধ্যে এক প্রতিবেশী রয়েছে বলে তাঁর সন্দেহ। তাঁরা একসঙ্গে জিমে যেতেন। পারিবারিক সম্পর্কও ছিল। তিন দিন আগে তাঁর সঙ্গে ওই ব্যক্তির শেষ দেখা হয়েছিল। সে যে ভাবে জিব্রিলকে বিদায় জানিয়েছিল, তাতে অবাক হন জিব্রিল। তাঁর কথায়, ‘‘ও এমনিতে ভাল লোকই মনে হয়েছিল। আমায় সে দিন বলল, ‘জিব্রিল তোমায় বিশ্বস্ত এবং মুসলিম হতে হবে। যদি তুমি বিশ্বস্ত না হও এবং মুসলিম হও, তা হলে নরকে যাবে’!’’

ছবি: এএফপি এবং রয়টার্স।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE