Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

হাত মিলিয়ে চলব, জিতে বললেন ট্রাম্প

অভাবনীয়! জনমত সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণ করে, সংবাদমাধ্যমের উচ্চকিত বিরোধী স্বরকে চাপা দিয়ে, বিপক্ষ শিবিরকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে, নিজের দলকে চমকে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন রিপাবলিকান পদপ্রার্থী ডোনাল্ড জন ট্রাম্প!

আলিঙ্গন। স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে সদ্য নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিউ ইয়র্কে। ছবি: রয়টার্স।

আলিঙ্গন। স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে সদ্য নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিউ ইয়র্কে। ছবি: রয়টার্স।

সংবাদ সংস্থা
ওয়াশিংটন শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:১৩
Share: Save:

অভাবনীয়!

জনমত সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণ করে, সংবাদমাধ্যমের উচ্চকিত বিরোধী স্বরকে চাপা দিয়ে, বিপক্ষ শিবিরকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে, নিজের দলকে চমকে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন রিপাবলিকান পদপ্রার্থী ডোনাল্ড জন ট্রাম্প!

সেই ট্রাম্প, মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে যিনি সমানে অনাস্থা দেখিয়ে গিয়েছেন। বলেছিলেন, না জিতলে ভোটের ফল গ্রাহ্যই করবেন না তিনি।

সেই ট্রাম্প, যিনি প্রতিপক্ষকে ‘ডাইনি’ বলে উল্লেখ করতেন। কুৎসা ও কটূ কথাকে হাতিয়ার করে প্রচার চালানোর এক অভাবনীয় নজির গড়েছিলেন তিনি।

সেই ট্রাম্প, যিনি গলা চড়িয়ে মহিলাদের শ্লীলতাহানি করার কথা বলেছেন, মেক্সিকানদের ধর্ষক বলতে দু’বার ভাবেননি, মুসলিমদের গলাধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বার করে দেওয়ার কথা বলেছেন বারবার।

সেই ট্রাম্প, যাঁকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ‘অপ্রকৃতিস্থ’ আখ্যা দিয়েছেন কয়েক দিন আগেই।

মঙ্গলবার রাত আড়াইটে নাগাদ স্পষ্ট হয়ে যায়, এ বারও দেশের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হওয়া হলো না হিলারি ক্লিন্টনের। সমর্থকদের সুখবরটি দিতে স্টেজে ওঠেন ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে সদ্য নির্বাচিত রিপাবলিকান মাইক পেন্‌স। তার কয়েক মিনিট পরেই মঞ্চে দেশের ‘প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট’। ‘আমেরিকা’, ‘আমেরিকা’ ধ্বনিতে তখন গমগম করছে হলঘর। উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে শুরু করেন ট্রাম্প।

মুখ খুলতেই চমক।

‘‘এই মাত্র সেক্রেটারি ক্লিন্টনের ফোন পেলাম। জয়ের জন্য আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। হ্যাঁ, আমাদের সকলকে। কারণ এই জয় আমাদের সকলের। হিলারিকে ধন্যবাদ জানাই। ত্রিশ বছর ধরে এই দেশকে সেবা করে আসছেন তিনি। আমরা সত্যিই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।’’

ট্রাম্প বলছেন এই কথা? ট্রাম্প! বিস্ময়ের আরও অনেক কিছু বাকি ছিল। গত ১৮ মাসের প্রচারে যাঁর মূল লক্ষ্য ছিল বিভেদ সৃষ্টি করা, বৈষম্যমূলক কথাবার্তা বলে সহজেই যিনি এক দল ভোটারকে পাশে টেনে নিয়েছেন, সেই ট্রাম্পের মুখে আজ শোনা গেল ঐক্যের কথা। বললেন, ‘‘বিভেদের ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে আমেরিকাকে এ বার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ দেশের সবাইকে বলছি— আমি আপনাদের সকলের প্রেসিডেন্ট হবো। সবাই মিলে আমেরিকাকে এক সুতোয় বাঁধব। সত্যি হবে ‘দ্য আমেরিকান ড্রিম’।’’

এমন পরিবর্তনও তা হলে হয়! পরিবর্তনের কথা বলে আট বছর আগের এক দিনে হোয়াইট হাউসে এসেছিলেন দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। সেই পরিবর্তনের মতো না হলেও আমেরিকার ঘরোয়া রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আজকের ফল কম ‘ঐতিহাসিক’ নয়। প্রশাসনের অলিন্দে জীবনে পা ফেলেননি, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া তো দূর অস্ত্‌, এ রকম এক জন মানুষের ওপর দেশ চালানোর আস্থা রেখে আমেরিকার ভোটাররা দেখিয়ে দিলেন, রাজনৈতিক টানাপড়েনে তাঁদের বিশেষ উৎসাহ নেই। বরং তাঁরা ভোট দিয়েছেন এই আশা করে যে, যেমন সফল ভাবে নিজের ব্যবসা চালিয়েছেন, তেমনই সাফল্যের সঙ্গে দেশ চালাবেন ট্রাম্প। ‘আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলব’— ট্রাম্পের এই আশ্বাসবাণীতেই আস্থা রেখেছেন তাঁরা।

আমি ডোনাল্ড

• জন্ম: ১৪ জুন, ১৯৪৬

• বাবা জার্মান, মা স্কটিশ

• রিয়েল এস্টেট ডেভেলপিংয়ের পারিবারিক ব্যবসা

• ১৩ বছরে নিউ ইয়র্ক মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে,
তবে যুদ্ধে যাওয়া হয়নি

• উচ্চশিক্ষা ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়।
হোয়ার্টন স্কুল অব ফিনান্স অ্যান্ড কমার্সে
পড়তে পড়তেই বাবার সংস্থায় কাজ

• অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়ার আগেই লাখপতি

• ১৯৭১-এ সংস্থার শীর্ষে, তৈরি ‘দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’

• বহুতল থেকে আবাসন, হোটেল, ক্যাসিনো, গল্ফ কোর্স,
মিডিয়া— রমরমা ব্যবসা। লাস ভেগাসে ৬৪ তলা হোটেল,
সব জানলায় ২৪ ক্যারাট সোনার জল

• ২০১৫ পর্যন্ত মিস ইউনিভার্স-সহ
তিনটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মালিক

• ২০০৩-এ জনপ্রিয় রিয়্যালিটি শো
দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’ প্রযোজনা ও অ্যাঙ্করিং

• অভিনয়: ‘হোম অ্যালোন-২’, ‘ওয়াল স্ট্রিট’-সহ
গোটা দশেক ছবিতে, প্রায় সবেতেই স্ব-ভূমিকায়

• মোট সম্পত্তি: ৩৭০ কোটি ডলার

• নিজস্ব একটি বোয়িং ৭৫৭-২০০,
একটি কর্পোরেট জেট, দু’টি হেলিকপ্টার

• গাড়িশালে রোলস রয়েস, মার্সিডিজ, ল্যাম্বর্গিনি,
ম্যাকলারেন,ক্যাডিলাক, টেসলা— কী নেই!

• বিয়ে তিন বার। বর্তমান স্ত্রী প্রাক্তন মডেল মেলানিয়া

• তিন বিয়েতে পাঁচটি সন্তান। তিন ছেলে, দুই মেয়ে

বাস্তব বলছে, আমেরিকার বহু শ্বেতাঙ্গ সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা স্বল্প শিক্ষিত, তাঁদের না আছে ভাল চাকরি, না আছে ব্যাঙ্কে কোনও টাকাপয়সা। বিভিন্ন দেশ থেকে কোটি কোটি অভিবাসী এসেছেন। উচ্চশিক্ষিত অভিবাসীদের ঝুলিতে ঢুকেছে সরকারি-বেসরকারি দফতরের উচ্চপদস্থ চাকরিগুলো। বংশানুক্রমে শিক্ষার মান কমেছে আমেরিকার এক শ্রেণির শ্বেতাঙ্গ মানুষের। তাঁদের চাপ আরও বাড়িয়েছেন মেক্সিকো থেকে ঢুকে পড়া লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী। আমেরিকার এই ‘মাল্টিকালচারাল’ ভাবমূর্তির খেসারত দিতে হচ্ছে, এই হতাশায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁরা সংখ্যায় বিশেষ কম নন। ট্রাম্পের দেখানো হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে মজেছেন এঁরাই। তাঁরাই ট্রাম্পের মূল ভোটব্যাঙ্ক।

তা-ও প্রশ্ন উঠছে, যে জয়কে ‘অভাবনীয়’, ‘অত্যাশ্চর্য’, এই সব বাছা বাছা উপমায় ভরিয়ে দিচ্ছে তামাম দুনিয়া, সেই জয়টা কি শুধু এই স্বল্পশিক্ষিত সাদা মানুষদের হাত ধরেই এল? এত সহজেই কি জয় হাসিল করলেন ট্রাম্প? ‘‘লড়াইটা আদপেই সহজ ছিল না,’’ আজ নিজেই বলেছেন ট্রাম্প। বলেছেন, ‘‘রাজনীতি করাটা যে কী পরিমাণ ঝামেলার, এই আঠারো মাসে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।’’ বিশ্লেষকেরা বলছেন,
ইসলামি সন্ত্রাস দমনে কঠোর মনোভাব, চাকরির সুযোগ বাড়ানো, বেআইনি অনুপ্রবেশ রোখা, ট্রাম্পের এই সব আশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরেছেন বহু মার্কিন। তাঁদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গরা তো রয়েইছেন। আছেন বহু এশীয় বংশোদ্ভূতও। সন্ত্রাসে দীর্ণ আমেরিকায়, আইএস হামলার ভয় রাত কাটানোর আমেরিকায়, অর্থনৈতিক ধস থেকে ঘুরে না-দাঁড়ানোর এই আমেরিকায় ট্রাম্পের মতো এক ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতাকেই তাঁদের ‘পথপ্রদর্শক’ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন আমেরিকার সাধারণ মানুষ।

জাতীয়তাবাদের হিড়িক তুলে কয়েক মাস আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্রিটেন। ব্রেক্সিটের জোরদার সমর্থকদের মধ্যে প্রথম সারিতেই ছিলেন রিপাবলিকান পদপ্রার্থী। তখন আবার অনেকে মজা করে বলেছিলেন, ব্রেক্সিট যদি দিনের আলো দেখে, তা হলে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়াও কেউ আটকাতে পারবে না। আজ তো তাই হলো।

ট্রাম্পের এই জয়ে হিলারির অবদানও অবশ্য নেহাত কম নয়। ই-মেল দুর্নীতি বা ক্লিন্টন ফাউন্ডেশনের আড়ালে আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ তো ছিলই। তা ছাড়া, হিলারি যে-ভাবে নিজেকে বারাক ওবামার উত্তরসূরি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, সেটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। কারণ, যে সব পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ওবামা, তার বেশির ভাগ তো বাস্তবায়িত হয়নি। ‘‘আমি এই এই কাজ করতে চাই,’’

এ রকম কোনও নতুন কথা শোনা যায়নি হিলারির প্রচারে। উল্টো দিকে ট্রাম্প বরাবরই দাপিয়ে বলে বেড়িয়েছেন, ‘‘মেক্সিকান অনুপ্রবেশকারীদের রুখতে দেশের দক্ষিণে দেওয়াল তুলব’’, ‘‘কড়া হাতে আইএস দমন করব’’, ‘‘আমাদের দেশে যারা হিংসা ছড়াবে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেব’’ বা আউটসোর্সিং বন্ধ করে আমাদের দেশের ছেলেছোকরাদের কাজের সুযোগ করে দেব।’’ সেই সব আশ্বাসের কোনও মূল্য আছে কি না, জানা যাবে আগামী চার বছরে। তার আগে, আগামিকাল প্রথামাফিক হোয়াইট হাউসে গিয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবেন ট্রাম্প। আর ২০ জানুয়ারি শপথ।

তবে তাঁদের নেতা যতই বিদ্বেষ ভুলে ঐক্যের কথা বলুন না কেন, তাঁর সমর্থকরা যে ‘হেট স্পিচ’-এর বেড়াজালের বাইরে এখনও পা রাখতে পারছেন না, তা স্পষ্ট হয়ে গেল ট্রাম্পের আজকের বিজয়সভাতেই। ট্রাম্প যখন হিলারিকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন, হল জুড়ে চিৎকার— ‘‘ওকে জেলে ভরা হোক। আজই।’’ তা ছাড়া সংবাদমাধ্যম সম্পর্কেও নানা কু-কথা শোনা গিয়েছে বহু বার।

ট্রাম্প অবশ্য সে সবে কান দেননি। ধন্যবাদ জ্ঞাপনের লম্বা তালিকা (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার পল রায়ান থেকে শুরু করে ট্রাম্পের ছোট ছেলে ব্রায়ান, কে নেই সেই তালিকায়!) শেষ করে মার্কিন ধনকুবের আলাপ করিয়ে দেন তাঁর সুবিশাল পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে। মা-বাবা গত হয়েছেন, মারা গিয়েছেন এক ভাইও। দুই বোন, এক ভাই, তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়া, পাঁচ-পাঁচটি ছেলেমেয়ে, সকলকে পাশে নিয়ে ম়ঞ্চে এক সুখী পরিবারের ছবি আঁকলেন তিনি।

এক সুখী শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পরিবার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE