Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পুজো-পুজো গন্ধটা আর খুঁজে পাই না

কলকাতা শহরতলির মফস্বলে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে, দেশের বাইরে এতগুলো বছর কেটে গেলেও  পুজোর সেই ‘হারিয়ে যাওয়া’ গন্ধটাকে আজও পাইনি।

সুসজ্জিত মণ্ডপ ও প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র

সুসজ্জিত মণ্ডপ ও প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র

কৌশিক নিয়োগী
সিঙ্গাপুর শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৫৪
Share: Save:

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখন হংকং-এ থাকতাম। এক মহাষ্টমীর সকালে কলকাতার পুজো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এক ইউরোপীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে মণ্ডপে বসে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় তিনি বললেন ‘সামথিং ইজ় মিসিং। নট শিওর হোয়াট ইট ইজ়, বাট আই থিঙ্ক ইটস দ্য স্মেল।’ দমকল বিভাগের নিয়ম মানতে গিয়ে তখন ধূপধুনো কিছুই জ্বালানো হত না অডিটোরিয়ামের মধ্যে মণ্ডপে। তাই হয় তো আমাদের প্রবাসের পুজোয়, কলকাতার পুজোর গন্ধটা না পেয়ে এক ভিন্‌ দেশির কাছেও তা ‘অন্য রকম’ ঠেকেছিল।

কলকাতা শহরতলির মফস্বলে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে, দেশের বাইরে এতগুলো বছর কেটে গেলেও পুজোর সেই ‘হারিয়ে যাওয়া’ গন্ধটাকে আজও পাইনি। পুজোর দিনগুলোয় সেই গন্ধগুলোকে তাই এখনও খুঁজে বেড়াই।

সিঙ্গাপুরে প্রথম যে বার সন্ধেবেলা পুজোর মণ্ডপে গেলাম, একটা অদ্ভুত ভাললাগা ছেয়ে ছিল। এখানে ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের’ পুজোটা হয় সেরাঙ্গুন রোডের ওপর একটা খোলা মাঠে, বিরাট প্যান্ডেল করে। ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অব সিঙ্গাপুরের’ পুজো আকারে, জনসমাগমে আজ ভারতের বাইরে সব থেকে বড় পুজোর একটা। দীপাবলি উপলক্ষে ‘লিটল ইন্ডিয়া শপকিপার্স অ্যান্ড হেরিটেজ অ্যাসোসিয়েশনের’ পক্ষ থেকে সেরাঙ্গুন রোডের প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা আলোয় সাজানো হয়, এক মাস আগে থেকেই। যত বারই এই রাস্তা দিয়ে মণ্ডপে আসি চন্দননগরের আলোর কারসাজির একটা পরশ পাই, ঠিক যেমনটা পেতাম কলেজ জীবনে। কিন্তু রাস্তায় সেই পরিচিত এগ রোল ভাজার গন্ধটা তো পাই না!

ইউটিউব ঘেঁটে মহালয়ার ভোরে যতই না বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চালিয়ে দিয়ে পুজোর আমেজটা তৈরি করার চেষ্টা করি, বাড়ির বাগানের শিউলি গাছ থেকে সকালের টাটকা ফুলের গন্ধটা পাই না। অঞ্জলি দিতে গিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্যান্ডেলে ফরাসি সুগন্ধীর সুবাস তো বেশ পাই, কিন্তু ফুল-বেলপাতার পরিচিত সেই গন্ধটা না-পাওয়াই থেকে যায়।

সিঙ্গাপুরে প্যান্ডেলের একটা দিক শুধু খাবার দোকানের জন্যই পুরো আলাদা করা থাকে। সিঙাড়া থেকে ফুচকা— সবই বিক্রি হয় ‘সিঙ্গাপুর ফুড এজেন্সি’র তীক্ষ্ণ তত্ত্বাবধানে। স্বাদটা কাছাকাছি এলেও কাগজের প্লেটে দেওয়া ফুচকায় শাল পাতার সেই গন্ধটাই বা কোথায়?

সিঙ্গাপুরে প্রতিমা আসে কুমোরটুলি থেকে, ফাইবার রি-ইন্‌ফোর্সড প্লাস্টিকের প্রতিমা। সাধারণত চার বছর পরে ‘পলিউশন ডিপার্টমেন্ট’-এর নিয়ম অনুযায়ী প্রতিমা ‘রিসাইকল’ করা হয়। তাই প্রতি বছর বিজয়ার দিন বরণের পরে সযত্নে প্লাস্টিক দিয়ে প্রতিমা মুড়ে প্লাইউডের বাক্সে ঢুকিয়ে গোডাউনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই প্লাস্টিকের একটা কড়া রাসায়নিক গন্ধ আছে। ঠাকুর বরণের জন্য যখন প্লাস্টিক মুড়ে প্রতিমা রাখা হয়, সেই গন্ধটা দিব্যি পাওয়া যায়।

বেশ মনে আছে, বিজয়ার দিন বিশাল দুর্গাপ্রতিমা ঠিকঠাক নামিয়ে গঙ্গায় বিসর্জনটা দেওয়াটা ছিল বেশ পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। পিছল ঘাটে নেমে গিয়ে কোমর জলে দাঁড়িয়ে ঠাকুর প্রদক্ষিণ করিয়ে আস্তে আস্তে প্রতিমা যখন নিমজ্জিত করা হত তখন খড়, কাঠামো, সদ্য ভেজা মাটির সোঁদা ঘ্রাণ, ফুল, বেলপাতা, ঘাটের পাশের দোকান থেকে ডালডায় ভাজা গজা-মিহিদানার গন্ধ— সব মিলেমিশে যে পরিবেশ তৈরি হত— সেটা এখানে বিজয়ার দিনে কিছুতেই পাওয়া সম্ভব নয়।

পরিচিত গন্ধগুলো এ ভাবে ‘নিখোঁজ’ই থেকে যায় আমার এই প্রবাসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja Singapore 2019 Durga Puja Special
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE