এলি উইজেল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ষাট লক্ষ ইহুদি নিধনের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন তিনি। শুধু সাক্ষী নয়, বলা ভাল তাঁর স্মৃতি দিয়ে গোটা বিশ্বের মননে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন নাৎসিদের হাতে ইহুদি নিধনের সেই পৈশাচিক অধ্যায়। শনিবার ম্যানহাটনে ৮৭ বছর বয়সে মারা গেলেন হলোকস্টের সেই মুখ, নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী এলি উইজেল। রয়ে গেল স্মৃতিকথা ‘নাইট’-এ তাঁর উক্তি, ‘‘মৃতদের ভুলে যাওয়াটা তাদের দ্বিতীয় বার মেরে ফেলার সমান।’’
জার্মানির বুখেনওয়াল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কিশোর বয়সে যে ভয়ঙ্কর দিনগুলো কাটিয়েছেন, তা-ই উঠে এসেছিল ‘নাইট’-এ। ইহুদি নিধনকে বর্ণনা করতে হলোকস্ট শব্দটি যাঁরা প্রথম ব্যবহার করতে শুরু করেন, এলি তাঁদের অন্যতম। ১৯৫৫ সালে লেখা এই বই আর পাঁচ বছরের মাথায় তার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে এলি উইজেলকে চিনেছিল সারা পৃথিবী। হিটলার জমানার বর্বরতার শিকার হওয়ার পরেও বেঁচে যাওয়ার যন্ত্রণা কুরে কুরে খেত তাঁকে। কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকতে না পারার দায়ভার যেন চেপে বসেছিল তাঁর উপরেই। ঈশ্বর কী ভাবে এই গণহত্যা হতে দিলেন, বিদ্ধ হয়েছিলেন সে ভাবনাতেও।
এলির লেখায় রয়েছে, ‘‘সে রাতটা কোনও দিন ভুলতে পারব না। ক্যাম্পের প্রথম রাত। আমার গোটা জীবনটাকেই যা একটা অভিশপ্ত দীর্ঘ রাতে পরিণত করেছিল। সেই ধোঁয়ার গন্ধ, সেই শিশুদের মুখ। একটা শান্ত নীল আকাশের নীচে ওদের শরীরগুলো থেকে পাকিয়ে উঠছে ঘন কালো ধোঁয়া। সেই আগুনের শিখা যা চিরকালের মতো আমার বিশ্বাসকে গ্রাস করেছিল। রাতের সেই নিস্তব্ধতা আমার বাঁচার ইচ্ছে কেড়ে নিয়েছিল। আমার ঈশ্বর, আমার আত্মাকে খুন করেছিল সেই মুহূর্তগুলো। আমার স্বপ্নগুলো মিশিয়ে দিয়েছিল ধুলোয়। যদি ঈশ্বরের মতো দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকার অভিশাপ নিয়ে চলতে হয়, তবুও কখনও ভুলব না সে সব।’’ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এত কিছুর পরেও কেন উন্মাদ হয়ে যাননি? এলির জবাব ছিল, ‘‘আজ পর্যন্ত আমার কাছেও সেটা একটা রহস্য।’’
রোমানিয়ার সিঘেট শহরে এলির জন্ম ১৯২৮-এ। ১৯৪৪ সালে এলির পরিবারকে পাঠানো হয় আউশউইৎস কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। এলির সঙ্গে ছিলেন তাঁর বাবা-মা এবং তিন বোন। বাবা, মা এবং এক বোন শেষ অবধি মারা যান। এলি আর তাঁর বাবাকে আউশউইৎস থেকে বুখেনওয়াল্ডে পাঠানো হয়েছিল। সেখান এলির চোখের সামনেই নাৎসিরা তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এই ঘটনার তিন মাস পরে মুক্ত হয় বুখেনওয়াল্ড। ২০০৯-এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে এলি এক বার ফিরে গিয়েছিলেন সেই ক্যাম্পে।
উপন্যাস, প্রবন্ধ, প্রতিবেদন, নাটক— লিখেছেন অনেক। হলোকস্ট নিয়ে তাঁর ৫০টিরও বেশি বই। ১৯৬৩ সালে মার্কিন নাগরিক হন। তার বহু আগে ১৯৮৫-তে হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন কংগ্রেসশনাল গোল্ড মেডেল নিতে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগনের তখন পশ্চিম জার্মানির বিটবুর্গে একটি সেনা সৌধে সফরে যাওয়ার কথা ছিল। হিটলারের বাহিনী ‘ওয়াফেন এসএস’-এর সদস্যদের দেহ সমাহিত ছিল সেখানে। রেগনের তীব্র সমালোচনা করে এলি বলেছিলেন, ‘‘ওই জায়গাটা আপনার নয় প্রেসিডেন্ট। এসএস যাঁদের হত্যা করেছিল, তাঁদের কাছে যাওয়া উচিত আপনার।’’ এর পরের বছরই এলি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান, ১৯৮৬ সালে। নোবেল কমিটি বলেছিল, ‘‘উইজেল মানবসমাজের দূত। তিনি যে বার্তা দিয়েছেন তা শান্তির, প্রায়শ্চিত্তের এবং মানবিক মর্যাদার।’’ এলি বিশ্বাস করতেন, ভালবাসার বিপরীত শব্দ ঘৃণা নয়, উদাসীনতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy