Advertisement
E-Paper

আমেরিকার নাকের ডগায় ছোট্ট দ্বীপের স্পর্ধার নাম ফিদেল কাস্ত্রো

আইজেনহাওয়ার থেকে ওবামা। দীর্ঘ যাত্রার শেষে অবশেষে ঘুমতে গেলেন বিপ্লবের শেষ বর্ণময় চরিত্র ফিদেল কাস্ত্রো। বিতর্ক থেকে প্রশস্তি- এই বর্ণময় জীবনে জুটেছে দু’টিই। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে— ফিদেল হিরো।

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ১৮:১৬
হোয়াইট হাউসের সামনে ফিদেল কাস্ত্রো। ছবি: সংগৃহীত।

হোয়াইট হাউসের সামনে ফিদেল কাস্ত্রো। ছবি: সংগৃহীত।

আইজেনহাওয়ার থেকে ওবামা। দীর্ঘ যাত্রার শেষে অবশেষে ঘুমোতে গেলেন বিপ্লবের শেষ বর্ণময় চরিত্র ফিদেল কাস্ত্রো। বিতর্ক থেকে প্রশস্তি- এই বর্ণময় জীবনে জুটেছে দু’টিই। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে— ফিদেল হিরো। ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী। কিন্তু ফ্লোরিডা, টেক্সাস–এ নির্বাসিত কিউবানদের চোখে তিনি ‘হিটলার’। মানবাধিকার সংগঠনগুলির রিপোর্টও তাঁর প্রতি সদয় নয়। ফিদেলের মৃত্যুসংবাদ জানার পরে ভোর রাতেও মায়ামির রাস্তাও জনতার ঢল। এই বিপুল বৈপরীত্য নিয়ে ফিদেলের জীবন। যে জীবনের অনেকটাই আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। বিপুল শক্তিশালী আমেরিকার সঙ্গে ক্ষুদ্র দ্বীপ কিউবার স্মরণীয় টক্কর। যে টক্করের পরতে পরতে নানা ওঠা-পড়া।

যে গল্পের শুরু ১৯৫৯-এ। সামরিক শাসক বাতিস্তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন ফিদেল। সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করেনি আইজেনহাওয়ারের সরকার। সে বছরের ১৫-২৬ এপ্রিল প্রেস ক্লাবের আমন্ত্রণে আমেরিকা এলেন ফিদেল ও তাঁর কয়েক জন সঙ্গী। ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিস্কনের সঙ্গে বৈঠকও হল। লিঙ্কন মেমোরিয়ালে গিয়ে পুষ্পস্তবকও দিয়ে এলেন। আর দেশে ফিরেই একে একে ব্যবসা ও কৃষিক্ষেত্রের জাতীয়করণ শুরু করলেন। কিউবায় মার্কিন বিনিয়োগে বড়সড় আগাত লাগল। সম্পর্কের অবনতির সেই শুরু। একের পরে এক ব্যবসা ও কৃষি খামারের জাতীয়করণ হয়েছে, মার্কিন সরকার একের পর এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। কিউবার প্রধান উৎপাদন চিনি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে আমেরিকা। বন্ধ করে দিয়েছে কিউবায় তেল বিক্রিও। জ্বালানী সঙ্কটে পড়ে যায় কিউবা। যা ক্রমেই কিউবাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত ধরতে এগিয়ে দিয়েছে।
একের পর এক টানাপড়েনের পর ১৯৬১তে দু’দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তার আগে, আইজেনহাওয়ারের আমলেই সেন্ট্রাল ইন্টালিজেন্স এজেন্সিকে (সিআইএ) নির্দেশ দেওয়া হয় কাস্ত্রোকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য। সেই শুরু।

সিআইএ–র প্রথম বড় চেষ্টা ১৯৬১-তেই। তাদের পরিকল্পনায় কিউবা থেকে নির্বাসিত প্রায় ১৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কিউবা আক্রমণ করা হল। ‘বে অব পিগস’-এর সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কিউবা এবং আমেরিকার সম্পর্ক প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তবে সিআইএ ক্ষান্ত থাকেনি। কাস্ত্রোর সরকারকে উৎখাত করতে, কাস্ত্রো-সহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যা করতে পরিকল্পনা চলতেই থাকে। এর ছদ্মনাম ছিল ‘অপারেশন মঙ্গুজ’।
সম্পর্কে সবচেয়ে সঙ্কটময় পরিস্থিতি আসে ১৯৬২ তে। মার্কিন গুপ্তচর বিমানের ছবিতে দেখা যায় কিউবার ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাঁটি গড়ছে রাশিয়া। শোরগোল পড়ে যায়। কেনেডির উপরে অবিলম্বে কিউবা আক্রমণের চাপ আসতে থাকে। কেনেডি মার্কিন নৌবাহিনীকে কিউবা ঘিরে ফেলার আদেশ দেন। পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘাঁটি বন্ধ করতে বলা হয়। পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কায় প্রহর গুণতে থাকে বাকি বিশ্ব। শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ঘাঁটিটি বন্ধ করে দেয়। হাঁফ ছাড়ে বাকি বিশ্ব। সিআইএ কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। পরে প্রকাশিত নথিতে দেখা যাচ্ছে ১৯৬০ থেকে ৬৫ পর্যন্ত প্রায় আট বার কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা করেছিল সিআইএ। সবকটিই ব্যর্থ।
তার পরে ৭০ দশক জুড়ে আমেরিকা ও কিউবার সম্পর্ক বিদ্বেষের সুরেই বাঁধা ছিল। কখনও সম্পর্কের সামান্য উন্নতি হয়েছে। কখনও অবনতি। আর অবনতির সঙ্গে সঙ্গে চেপেছে ভুরি ভুরি নিষেধাজ্ঞা। যার ফলে কিউবার অর্থনীতি একের পর এক আঘাত। কিন্তু সোভিয়েত সাহায্যে কোনও ক্রমে টিকে গিয়েছে।
কিন্তু কিউবার মধ্যে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছিল। ১৯৮০-এর এপ্রিলে সেই ক্ষুব্ধদের একাংশ হাভানায় পেরুর দূতাবাসে গিয়ে ভিড় করেন আশ্রয়ের জন্য। সংখ্যাটি প্রায় ১০ হাজার। কাস্ত্রো জানান, যাঁরা চাইছেন কিউবা ছেড়ে চলে যেতে পারেন। সেই বছরে এ ভাবে প্রায় এক লক্ষ ২৫ হাজার কিউবার বাসিন্দা আমেরিকা চলে আসেন। প্রেসিডেন্ট রোলান্ড রেগন সরকার নিষেধাজ্ঞা আরও তীব্র করে। শুধু কিউবায় প্রচার চালানোর জন্য আলাদা রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল খোলা হয়। কিন্তু কাস্ত্রোকে সরানো সম্ভব হয়নি।
১৯৯১-এ সোভিয়েতের পতনের পরে প্রায় একা হয়ে পড়ে কিউবা। কিউবার অর্থনীতি চরম দুর্যোগের সামনে পড়ে। অনেক কষ্টে তা সামলানোর চেষ্টা করেছেন কাস্ত্রো। যদিও তা নিয়ে প্রবল সমালোচনা হয়েছে। বরাবরই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টরা কিউবার উপরে চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আর ডেমোক্র্যাটরা চেষ্টা করেছেন সম্পর্কের উন্নতির। বিল ক্লিন্টনের আমলে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হয়। বিশেষ করে দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু আবার জর্জ বুশ জুনিয়রের আমলে নিষেধাজ্ঞার বেড়ি শক্ত করা হয়।
কিউবা নীতির বড়সড় পরিবর্তন আনেন বারাক ওবামা। তবে তার আগেই ২০০৬-এ ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে দায়িত্ব থেকে সরে গিয়েছেন ফিদেল। পদে বসেছেন তাঁর ভাই রাইল কাস্ত্রো। ভ্যাটিকানে পোপ ফ্রান্সিস অনুঘটকের কাজ করেন। দীর্ঘ গোপন আলোচনার পরে কিউবা ও আমেরিকা আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। কিউবাকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্টের তালিকা থেকে সরিয়ে দেয় আমেরিকা। ২০১৫-এর জুলাই-এ হাভানা ও ওয়াশিংটনে দু’দেশের দূতাবাস খুলে যায়। ২০১৬-এর মার্চে হাভানা যান স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পুরো ব্যাপারটিকে যদিও ভাল চোখে দেখেননি ফিদেল।
১১ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাল পেরিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। যদিও কিউবার বুকে তাঁর দীর্ঘ ছায়াটি রয়েছে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্পের কথাবার্তায় কিউবা বিরোধিতা স্পষ্ট। তাঁর আশপাশের পরামর্শদাতারা কিউবার প্রতি খুব একদা সদয় নন। সেই ফিদেল-হীন কিউবার সঙ্গে কেমন হবে মার্কিন সম্পর্ক তা ভবিষ্যতই বলবে।

আরও খবর...

ফিদেল কাস্ত্রো প্রয়াত

সিঁড়ি ভাঙতে স্বপ্ন ‘মেক ইন আমেরিকা’-ই

‘তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম!’ ফিদেলকে লিখেছিলেন চে

সাম্রাজ্যবাদী হিংসার বিরুদ্ধে নীল আকাশের নাম

৬৩৪ বার খুন করার চেষ্টা হয়েছে ফিদেলকে?

‘বিয়ার হাগ’ দিয়ে ইন্দিরাকে চমকে দিয়েছিলেন কাস্ত্রো

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ফিদেলের ছিল গভীর শ্রদ্ধা

কাস্ত্রোর প্রয়াণে শোকাহত বাংলাদেশ

ফিদেল কাস্ত্রোর প্রয়াণে টুইট করলেন যাঁরা

Fidel Castro US
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy