Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাজারকে সামলানোর পথ বাতলে নোবেল জয় ফরাসি অর্থনীতিবিদের

বাজারের অনিয়ন্ত্রিত শক্তির ওপর লাগাম পরানোর তত্ত্বের জনক হিসেবে নোবেল পেলেন ফরাসি অর্থনীতিবিদ, তুলুজ স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অধ্যাপক, জঁ তিরোল। নোবেল কমিটির বিবৃতি বলছে, ‘মার্কেট পাওয়ার অ্যান্ড রেগুলেশন’-এর বিশ্লেষণের জন্যই এই সম্মান। বাজারকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চলতে দিলে যে বিপদ, কথাটা পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরাও জানেন। তাঁদের সমাধানসূত্র সরল: ‘নব্য সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন ষড়যন্ত্রের কালো হাত’ ভেঙে এবং গুঁড়িয়ে দিলেই চলবে। কাজটা আসলে আর একটু কঠিন।

নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ পাওয়ার পরে তুলুজ স্কুল অব ইকনমিক্সে সাংবাদিক বৈঠকে জঁ তিরোল। সোমবার। ছবি: রয়টার্স

নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ পাওয়ার পরে তুলুজ স্কুল অব ইকনমিক্সে সাংবাদিক বৈঠকে জঁ তিরোল। সোমবার। ছবি: রয়টার্স

অমিতাভ গুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৩৬
Share: Save:

বাজারের অনিয়ন্ত্রিত শক্তির ওপর লাগাম পরানোর তত্ত্বের জনক হিসেবে নোবেল পেলেন ফরাসি অর্থনীতিবিদ, তুলুজ স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অধ্যাপক, জঁ তিরোল। নোবেল কমিটির বিবৃতি বলছে, ‘মার্কেট পাওয়ার অ্যান্ড রেগুলেশন’-এর বিশ্লেষণের জন্যই এই সম্মান।

বাজারকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চলতে দিলে যে বিপদ, কথাটা পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরাও জানেন। তাঁদের সমাধানসূত্র সরল: ‘নব্য সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন ষড়যন্ত্রের কালো হাত’ ভেঙে এবং গুঁড়িয়ে দিলেই চলবে। কাজটা আসলে আর একটু কঠিন। ৬১ বছর বয়সী তিরোলের তিন দশক ব্যাপী গবেষণা এবং আধুনিক অর্থনীতি ও আর্থিক নজরদারি-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর তাঁর প্রভাব সে কথাই বলছে। এ বছর তাঁকে পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি কথাটি স্বীকার করে নিল।

গোটা দুনিয়ার অর্থনীতিতেই বড় সংস্থার গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। ব্যাঙ্ক থেকে বিমা, মোবাইল পরিষেবা থেকে খুচরো বিপণন বা ঠান্ডা পানীয় প্রায় সব ব্যবসাতেই হাতে গোনা কয়েকটা সংস্থার দখলে দুনিয়ার বাজারের সিংহভাগ। অর্থনীতির পরিভাষায় এই গোত্রের বাজারের নাম অলিগোপলি। কিছু ক্ষেত্রে আবার একাধিক নয়, একটিমাত্র সংস্থাই দখল করে রাখে দুনিয়ার বাজার। তার নাম মোনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা। অলিগোপলি বা মোনোপলির অধিকারী বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে ক্ষমতা বিপুল। তাদের সামলানো না গেলে তারা যথেচ্ছ দাম আদায় করতে পারে। অথবা, অপেক্ষাকৃত কুশলী এবং উৎপাদনশীল নতুন সংস্থাকে বাজারে ঢুকতে না দিতে পারে। অতএব, তাদের লাগাম ধরে না রাখলে ক্রেতার ক্ষতি।

কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই গোত্রের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিকে, সে বিষয়ে আলোচনা করে অর্থনীতির যে শাখা, তার নাম ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন’ বা ‘শিল্প সংগঠন’। শিল্প সংগঠনের তত্ত্বে তিরোল প্রাণপুরুষ। তিনি দেখিয়েছেন, একচেটিয়া ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করার যে পদ্ধতির কথা অর্থনীতির তত্ত্ব অনেক দিন ধরে বলে এসেছে, তাতে কাজের চেয়ে অকাজ হয় বেশি। প্রতিটি শিল্পের ক্ষেত্রে যে নিয়ন্ত্রণের পৃথক পথের সন্ধান করতে হবে, তা-ও প্রথম বলেন তিরোল। টেলি-কমিউনিকেশন থেকে ব্যাঙ্কিং, বিদ্যুৎ সরবরাহ, তাঁর তথ্যভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রটি বিস্তৃত। তথ্যের অসমতা কী ভাবে প্রভাবিত করে বাজারকে, তিরোল তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন, সরকারের একটা প্রধান কাজ এই অসমতা দূর করা।

বিশ্ব ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে, তিরোলের প্রধান কৃতিত্ব বাস্তবের ওপর দাঁড়িয়ে প্রগাঢ় বিশ্লেষণীশক্তি ও গণিত ব্যবহার করে তত্ত্ব নির্মাণ। বললেন, “ভীষণ ভাল লাগছে। এক জন আদর্শ অর্থনীতিবিদের যেমন হওয়া উচিত, তিরোল ঠিক তেমন। তাঁর কাজ গভীর ভাবে বিশ্লেষণী, কিন্তু কখনও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন নয়। মাইক্রো-ইকনমিক্স-এর সব শাখাতেই তিরোলের স্বচ্ছন্দ বিচরণ, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ ও কর্পোরেট ফিন্যান্সের ক্ষেত্রে তাঁর কাজ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিদিন খবরের কাগজে নাম উঠবে, এমন অর্থনীতিবিদ তিরোল নন। তাঁর কাজ সাধারণের আওতার খানিক বাইরেই। কিন্তু তার কী প্রভাব, সেটা ক্রমে বোঝা যায়।”

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প সংগঠনের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ কৃষ্ণেন্দু ঘোষ দস্তিদারও বললেন, “তাঁর অকালপ্রয়াত সহকর্মী জঁ-জাঁক লাফোঁর সঙ্গে তিরোলের একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশে সরকারি নীতির অন্তর্গত হয়েছে।”

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক বললেন, “আমার যে আলমারিতে অর্থনীতির সবচেয়ে জরুরি বইগুলো থাকে, সেখানে তিরোলের চারটে বই আছে। আর কারও এত বই নেই সেখানে। ঘেঁটে দেখলাম, তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষীণতনুটি ৫০০ পাতার! তত্ত্ব আর অঙ্কে ঠাসা। তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদে আমি উচ্ছ্বসিত। তিনি উঁচু দরের তাত্ত্বিক তো বটেই, তাঁর তত্ত্ব কিন্তু বাস্তব সমস্যা আর ধাঁধার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।” বাস্তবের জটিলতাকে অর্থনীতির তত্ত্বে গেঁথে নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজাকেই স্বীকৃতি দিল তিরোলের নোবেলপ্রাপ্তি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jean tirole amitabha gupta nobel in economics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE