E-Paper

পুরনো মেজাজ ফিরছে, দেশকে উজ্জ্বল করাই পরীক্ষা কারকির

গত কাল রাতে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন নেপালের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকি। আজ এখানকার মানুষের মুখে যে হাসি, আচরণ-ব্যবহারে যে স্বস্তির ভাব, তা দীর্ঘমেয়াদি হবে কি না, অনেকটাই নির্ভর করছে তাঁর হাতে।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:২৫
সুশীলা কারকি।

সুশীলা কারকি। —ফাইল চিত্র।

ধ্বংসের মধ্য থেকে পুরাণ পাখির মতো জেগে উঠছে কাঠমান্ডু। তিন দিন আগে এসেছিলাম এক আতঙ্কনগরে। বাহাত্তর ঘণ্টায়, রাজনীতির জল ঘোলা করে তুল্যমূল্য শান্তি ফিরছে। আজ কার্ফু উঠে যাওয়ায় কাঠমান্ডু যেন পুরনো মেজাজে। বাজার, বিপণিতে মানুষের মুখে হাসি। এতই ভিড় এবং যান চলাচল যে, রাস্তা পার হতে অসুবিধা হচ্ছে। সেনা ফিরে গিয়েছে ব্যারাকে। কাঠমান্ডুর পুলিশ এখন আবার দখল নিয়েছে রাজধানীর নিরাপত্তার। সেই শ্মশানের মতো খাঁ-খাঁ রাস্তা আর নেই।

গত কাল রাতে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন নেপালের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকি। আজ এখানকার মানুষের মুখে যে হাসি, আচরণ-ব্যবহারে যে স্বস্তির ভাব, তা দীর্ঘমেয়াদি হবে কি না, অনেকটাই নির্ভর করছে তাঁর হাতে। প্রেসিডেন্টের দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পরিস্থিতি ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে ভোট করানোর চেষ্টা করা হবে। কাঠমান্ডুর বহু রাজনৈতিক নাগরদোলায় সওয়ার হওয়া অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, এক যুদ্ধ শেষ হল। নতুন যুদ্ধ শুরু হচ্ছে। যেখানে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ!

নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আজ শহরের হাসপাতালগুলিতে ঘুরেছেন কারকি, হিংসার জেরে আহতদের সঙ্গে দেখা করেছেন। রাতে বসেছেন জেন জ়ি-র প্রতিনিধিদের সঙ্গে, নতুন মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ নিয়ে কথা হয়েছে দু'পক্ষের। সংসদকে ভেঙে দিয়ে যে ব্যবস্থায় এক জন অসাংসদকে প্রধানমন্ত্রী করা হল জেন জ়ি-র কুকরির সামনে, তা কতটা রাজনৈতিক এবং আইনিভাবে টেঁকসই হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আজ থেকেই উঠতে শুরু করেছে। সূত্রের খবর, গত বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ যখন আগুন জ্বলছে কাঠমান্ডুতে, সেনাবাহিনী তিন প্রধান রাজনৈতিক নেতা কে পি ওলি, শের বাহাদুর দেওবা এবং প্রচন্ডের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি রামকৃষ্ণ পৌডেল এবং সুশীলা কারকির বৈঠক করান। সেই বৈঠকে উত্তেজিত বাক্য বিনিময়ের জেরে উঠে চলে যান সুশীলা। নেতারা চাপ তৈরি করেছিলেন, নতুন সরকারে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে এবং এই সংসদ ভাঙা চলবে না। সংসদ ভেঙে দিলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হবে। ইঙ্গিত স্পষ্ট, তাঁরা চাননি দান পুরোপুরি ছেড়ে দিতে। কারণ, ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ এবং দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি তৈরি হলে তাঁদের রক্ষাকবচ থাকবে না।

শেষ পর্যন্ত জেন জ়ি-র চাপের কাছে হার মানতে হল দেওবা, ওলিদের। কিন্তু সব জেতা-হারা সাদা-কালোয় ভাগ করা যায় না, মনে করছে নেপালের রাজনৈতিক মহল। নেপালের আমলাতন্ত্র এবং পুলিশি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভাবে কব্জা করে রেখেছে এখানকার তিন রাজনৈতিক দল— নেপালি কংগ্রেস, এনসিপি (ইউএমএল) এবং এনসিপি (মাওবাদী)। দলদাস এই আমলা এবং পুলিশের কতটা সহযোগিতা পাবেন কারকি, তা নিয়ে সংশয় আছে। বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং সংবাদমাধ্যমের সিংহভাগের উপরেও এই তিন দলের প্রভাব অনস্বীকার্য। অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেওয়া কাঠমান্ডুর নির্দল মেয়র বলেন্দ্র শাহ বা রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্রপার্টির নেতা রবি লামিচানের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রশাসন যন্ত্রে তেমন প্রভাব কোথায়? ঘটনাচক্রে, লামিচানেকে বিক্ষোভের দিন জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন বিক্ষোভকারীরা। এ দিন, নিজের জন্মদিনে ‘উপহারস্বরূপ’ তিনি জেলে ফিরে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। আরও জানান, ন্যায়ের প্রতীক হিসাবে দেশ নতুন প্রধানমন্ত্রীকে পেয়েছে। তাই তিনি আশাবাদী, তাঁর প্রতি আর অবিচার হবে না।

এ দিকে, সংসদ ভেঙে সরকার গঠন নিয়ে বিরোধিতা শুরু হয়েছে বলে খবর। সুপ্রিম কোর্টে মামলাও করবে দলগুলি। যে নিয়োগপত্র প্রেসিডেন্ট গত কাল কারকিকে দিয়েছেন, বলা হবে, তা সংবিধান-বিরুদ্ধ। যদিও একাংশ বলছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে কারকির নিজের প্রভাব যথেষ্ট। তিনি বিষয়টি সামলে দিতে পারবেন।

কারকির প্রথম কাজ, অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে নেপালে হিংসার কারণ অনুসন্ধান, দোষীদের চিহ্নিত করা এবং সর্বোপরি পুলিশের গুলিচালনায় মাধ্যমে রাষ্ট্র অন্যায় ভাবে ক্ষমতা দেখিয়েছে— তা প্রতিপন্ন করা। এই কাজে প্রয়োজনে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী (ওলি), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের গ্রেফতার করানোর কথা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে দেশ জুড়ে দলগুলি রাস্তায় নামবে, বিতর্ক ও প্রতিরোধ তৈরি হবে। আবার যদি তিনি তা না করেন, তা হলে জেন জ়ি টুঁটি টিপে ধরবে কারকির সরকারের।

সামনে নেপালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় উৎসব, ‘দশহরা’ বা ‘বড়া দশাই’। পনেরো দিন নেপালের সমস্ত কিছু বন্ধ থাকে এই উপলক্ষে। দ্রুত পরিস্থিতির চোখে পড়ার মতো উন্নতি করতে হবে কারকিকে। দশহরাকে লক্ষ্যে রেখে নতুন আর্থিক বর্ষের শুরুতেই (এখানে শাওন থেকে পরের আষাঢ় পর্যন্ত অর্থবর্ষ) সরকার সমস্ত বেতন, উৎসব বোনাস এবং বকেয়া দিয়ে থাকে। বহু সরকারি অফিসের নথি নষ্ট হয়েছে। অনেক কিছুই নতুন করে শুরু করতে হবে সরকারকে। সে জন্য প্রয়োজন মসৃণ সরকারি যন্ত্র। কারকির সামনে চ্যালেঞ্জ, এই অবস্থার মোকাবিলা করা। বড়া দশাই আলোকজ্জ্বল করা তাঁর কাছে তাই অগ্নিপরীক্ষার মতো।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Nepal Unrest Nepal Nepal Protest Nepal Violence Nepal Prime Minister Sushila Karki

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy