Advertisement
১৪ অক্টোবর ২০২৪
Anurag Maloo

৬০০০ মিটার উচ্চতা থেকে গড়িয়ে পড়ে ঢুকে যান গভীর বরফের ফাটলে! কেমন ছিল সেই ‘ক্রেভাস-যাপন?’

২০২৩ সালের এপ্রিলে অন্নপূর্ণা (৮০৯১ মিটার) শৃঙ্গাভিযানে গিয়েছিলেন রাজস্থানের কিষাণগড়ের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী অনুরাগ। কিন্তু শীর্ষে পৌঁছনোর আগেই ফিরতে হয়। পরদিন, ১৭ এপ্রিল সকালে নীচে নামার পথে ঘটে সেই অঘটন।

(বাঁ দিকে) ক্রেভাসের ভিতরে এ ভাবেই বরফাবৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল অনুরাগকে। শহরে অনুরাগ মালু (ডান দিকে)।

(বাঁ দিকে) ক্রেভাসের ভিতরে এ ভাবেই বরফাবৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল অনুরাগকে। শহরে অনুরাগ মালু (ডান দিকে)। ছবি: অ্যাডাম বাইলাকির ইনস্টাগ্রাম থেকে ও নিজস্ব চিত্র।

স্বাতী মল্লিক
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৪ ০৮:৪৫
Share: Save:

নেপালের অন্নপূর্ণা অভিযানে গিয়েই ভুলটা করেছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের পর্বতারোহী। ক্যাম্প ৩ থেকে ক্যাম্প ২-এর পথে সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশে ‘র‌্যাপলিং’ করার জন্য ভুল দড়ি ধরে ফেলেন। মুহূর্তে প্রায় ৬০০০ মিটার উচ্চতা থেকে গড়িয়ে পড়ে ঢুকে যান ৭০ মিটার গভীর বরফের ফাটলে (ক্রেভাসে)! এর পরে সেখানেই অন্তহীন প্রতীক্ষা। সে সময়ে ক্যামেরায় অনেক কিছুই রেকর্ড করেছিলেন অনুরাগ মালু। বলছেন, ‘‘ক্রেভাসে অনেক ভিডিয়ো করেছিলাম। আশা ছিল, কেউ আসবে। তৃতীয় দিনের ভিডিয়োয় পরিবার ও বন্ধুদের হাসিমুখে বিদায় জানাই। কারণ, ক্যামেরার ব্যাটারি ফুরিয়ে আসছিল।’’ ৭২ ঘণ্টা পরে যতক্ষণে উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছয়, ততক্ষণে আপাদমস্তক বরফে ঢাকা পড়েছেন ওই যুবক।

‘অন্নপূর্ণার বরপুত্র’, ‘অলৌকিক মানুষ’, ‘সাহসী হৃদয়’— গত ১৫ মাসে এমন নানা তকমা পাওয়া অনুরাগ নিজেকে ‘অন্নপূর্ণার অনুরাগ’ বলতেই ভালবাসেন। জীবনের প্রথম আট হাজারি শৃঙ্গাভিযানে ক্রেভাসে তলিয়ে গিয়েও পুনর্জন্ম পাওয়া অনুরাগ তাই আজ অকুতোভয়। কলকাতায় এসে তিনি বলেন, ‘‘দ্বিতীয় আমিটা অন্য মানুষ। ভয়, বিশ্বাসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বদলে গিয়েছে। ‘অল ইজ ওয়েল’— এটাই এখন জীবন-দর্শন।’’

২০২৩ সালের এপ্রিলে অন্নপূর্ণা (৮০৯১ মিটার) শৃঙ্গাভিযানে গিয়েছিলেন রাজস্থানের কিষাণগড়ের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী অনুরাগ। কিন্তু শীর্ষে পৌঁছনোর আগেই ফিরতে হয়। পরদিন, ১৭ এপ্রিল সকালে নীচে নামার পথে ঘটে সেই অঘটন। তবে এই কাহিনি তাঁর প্রত্যাবর্তন, পুনরুত্থান ও হার না-মানা মানসিকতার কথা বলে। কারণ, দিন চারেক পরে ক্রেভাসের গর্ভে প্রায় আপাদমস্তক তুষারচাপা অবস্থায় অনুরাগকে জীবন্ত খুঁজে পায় উদ্ধারকারী দল!

‘ভার্টিকাল লিমিট্‌স’ ছবির নায়িকার মতো তিনিও কি সেখানে উদ্ধারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন? ভেবেছিলেন, ক্রেভাস-যাপন শেষে দিনের আলো দেখবেন? অনুরাগের মন থেকে সেইসব স্মৃতি আজ মুছে গিয়েছে। বলছেন, ‘‘কী ভাবে ক্রেভাসে পড়েছি, ওই তিন দিন কী কী করেছি, কিচ্ছু মনে নেই। গত নভেম্বরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে পরিবার ক্যামেরার সেইসব ফুটেজ দেখায়। তা দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম।’’

পোল্যান্ডের দুই পর্বতারোহী ও নেপালি শেরপা-সহ আট জনের উদ্ধারকারী দলটি অবশ্য ধরেই নিয়েছিল, দেহ উদ্ধার করতে হবে। পর্বতারোহী অ্যাডাম বাইলাকি ক্রেভাসের ভিতরে ৬০ মিটার পর্যন্ত নেমেও অনুরাগকে দেখতে পাননি। এর পরে ৬৮ মিটার নীচে সম্পূর্ণ বরফাবৃত অনুরাগের মাথাটুকু নজরে আসে। ওই যুবকের কথায়, ‘‘হয়তো ১৯ তারিখ রাতে বড় কোনও তুষারধসে পুরোপুরি চাপা পড়ি ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। অ্যাডামও ভেবেছিল, মরে গিয়েছি। ধাক্কা মারতে নড়ে উঠি। ও চমকে ওঠে। আমার চোখে টর্চ ফেলে নিশ্চিত হয় যে, তখনও বেঁচে আছি!’’

অলীক-কথনের এখানেই শেষ নয়! পুনরুত্থানের পরে হেলিকপ্টারে কাঠমান্ডুর হাসপাতালে যখন অনুরাগকে আনা হয়, আশা বিশেষ ছিল না। টানা চার ঘণ্টা পাঁচ মিনিট সিপিআর দেওয়ার পরে প্রথম শ্বাস নেন তিনি। ১০-১২ দিন কোমায় ছিলেন। বাকি জীবন ভেজিটেটিভ অবস্থায় কাটবে কি না, কেউ জানতেন না। কোমা থেকে ফিরলে ডাক্তারেরা বুঝতে পারেন, তাঁর মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করছে। এর পরে দিল্লির এমস হাসপাতালে এনে চলে বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচার। ১৩ জুন অনুরাগের জন্মদিনে ডাক্তারেরা আশা দেখান, হয়তো সঙ্কট কেটে গিয়েছে। অনুরাগের শরীরের ডান দিকের বেশিরভাগ চামড়া এখন গ্রাফটিং করা। হারিয়েছেন ডান হাতের পাঁচটি আঙুলের ডগা। নতুন করে হাঁটতে, খেতে শিখেছেন। ওজন নেমেছিল ৪৩ কেজিতে। মৃত্যুকে ছুঁয়ে, প্রায় ২০০ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে নভেম্বরে বাড়ি ফিরেছেন। পায়ের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনুরাগ বললেন, ‘‘চিকিৎসা এখনও চলছে। গত সপ্তাহেই (১৫ জুলাই) পায়ের আঙুলে ছোট অস্ত্রোপচার হয়েছে। আশা করছি, এটাই শেষ অস্ত্রোপচার।’’

অথচ গত বছর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন পর পর অন্নপূর্ণা, এভারেস্ট, লোৎসে, মাকালু অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে। তার আগে নুন, আমা দাবলামের মতো ছয়-সাত হাজারি শৃঙ্গে অভিযান করে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে ছিলেন অনুরাগ। এক সঙ্গে একাধিক শৃঙ্গাভিযানের সাম্প্রতিক প্রবণতার সঙ্গে তাল মেলাতেই কী এমন পরিকল্পনা? অনুরাগের যুক্তি, ‘‘দেশি-বিদেশি অনেক পর্বতারোহী সফল ভাবে একাধিক শৃঙ্গাভিযান করে দেখিয়েছেন। তাই মনে হয়েছিল, আমিও পারব। বছর বছর টানা কয়েক মাসের ছুটি পাওয়া তো সম্ভব নয়। তাই সবচেয়ে কঠিন শৃঙ্গে সফল হলে যে কোনও পাহাড়ই করতে পারব— সেই ভাবনা থেকেই প্রথম পছন্দ ছিল অন্নপূর্ণা।’’

তবে দ্বিতীয় ইনিংসে জীবনের ক্রিজে টিকে থাকাটাই অনুরাগের কাছে ‘অন্নপূর্ণার আশীর্বাদ’। এখন চলছে বই, তথ্যচিত্র তৈরি নিয়ে কাজ। তবে পাহাড়ের স্বপ্নটা মিলিয়ে যায়নি। বলছেন, ‘‘পাহাড় আর পরিবার অনুমতি দিলে, আবার যাব। তার আগে সব কিছু প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। নিজেকে প্রস্তুত করতে পারলে অন্নপূর্ণার পথেই ফিরতে চাই।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Anurag Maloo Indian climber Mount Annapurna
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE