Advertisement
E-Paper

‘ছোট্ট ছেলের মুখ চেপে ৫৩ ঘণ্টা হেঁটেছি’! আইএস ডেরা থেকে পালিয়ে বললেন মহিলা

ফারিয়ালের কথায়, ‘‘জঙ্গিদের দলে এক জনকে সবাই আবু কাত্তাব বলে ডাকছিল। সেই ছিল সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর, কঠোর অত্যাচারী। আমার স্বামী হোশিয়ারকে এমন মেরেছিল, যে তাঁর উঠে বসার ক্ষমতা ছিল না। আর অন্য একজন আমার ছেলেকে কোল থেকে নিয়ে ওর হাতটা গরম জলে চুবিয়ে দিল। চোখের সামনে ওই দৃশ্য দেখে যে কী ভাবে বেঁচে ছিলাম, এখন ভাবলেও শিউরে উঠি। ওর চুল কেটে দেওয়া হল, ভয়ে ওইটুকু ছেলেরও কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, থেমে গিয়েছিল হাসি।’’

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৬:৩০
জঙ্গি কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঘরে ফেরা। ছবি: সংগৃহীত

জঙ্গি কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঘরে ফেরা। ছবি: সংগৃহীত

অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফেরা। দাসত্ব-বন্দিদশা থেকে মুক্তির পথে যাত্রা।পাঁচ বছরের ছেলে কোলে নিয়ে এক নারীর সেই পথ পেরোতে লাগল ৫৩ ঘণ্টা। মাঝপথের বীভৎসতা, ভয়াবহতা আর হাড় হিম করা আতঙ্ককে জয় করার। অন্ধকার আলপথে লাশের সার টপকে, এক রত্তি ছেলের নাগাড়ে কান্না চেপে ঘরে ফেরার। সাড়ে চার বছর আইএস জঙ্গি ডেরায় সাড়ে চার বছর কাটিয়ে সম্প্রতি ঘরে ফেরার দুঃসহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এখনও বুক কেঁপে উঠেছে ফারিয়ালের।

ইরাকে ইয়াজিরি বনাম কুর্দি লড়াই চিরাচরিত। সেই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়েই ইয়াজিরিদের সমর্থন করে আইএস জঙ্গিরা। ২০১৪ সালে তেল বানাত গ্রাম থেকে ফারিয়াল ও তাঁর মাস ছয়েকের ছেলের মতো কয়েক হাজার নারী-পুরুষকে এক দিনেই অপহরণ করেছিল এই আইএস জঙ্গিরা। গাড়িতে গরু-ছাগলের মতো গাদাগাদি করে সিরিয়ার বাঘউজ গ্রামে নিজেদের ডেরায় নিয়ে গিয়ে পুরুষদের হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল। মহিলাদের বানিয়েছিল যৌন দাসী। সেই ঘটনাকেই রাষ্ট্রসংঘ ‘গণহত্যা’ বলেছিল। ওই এলাকায় আকাশপথে হামলা এবং সেনা অভিযান চালিয়েছিল আমেরিকা।

কিন্তু তাতেও মুক্তি মেলেনি। ‘‘এই সাড়ে চার বছরে আমি ছ’জনের ক্রীতদাস ছিলাম। কখনও টাকার জন্য কখনও বা দেনা শোধ করতে আমাকে অন্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হত। তার সঙ্গে মারধর থেকে অত্যাচার তো ছিলই। ওরা আমাদের সঙ্গে পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করেছে।’’ ষষ্ঠবারের চেষ্টায় জঙ্গিদের বেয়নেট -বুলেট এড়িয়ে মুক্তি পেয়ে ফারিয়াল বলছিলেন সিরিয়ার আমুডার এক বাড়িতে বসে। পাঁচ বছরের ছেলের চোখেমুখে তখনও আতঙ্ক। সদ্য পিছনে ফেলে আসা অতীতকে স্মরণ করতে গিয়ে বারবার ধরে এসেছে ফারিয়ালের কণ্ঠস্বর। চোখ ভিজে গিয়েছে জলে। মুক্তির আনন্দে, অথবা জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের স্মরণে।

আরও পড়ুন: ‘টোম্যাটোর জবাব অ্যাটম বম্ব’! পাক সাংবাদিকের ভিডিয়ো ভাইরাল, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে বিঁধল নেটিজেনরা

সংবাদ মাধ্যমে ফারিয়াল তাঁর কাহিনি জানিয়েছেন গোড়া থেকেই। ২০১৪ সালের এক বিকেলে কী ভাবে তাঁদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল জঙ্গিরা। ‘‘কয়েক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, আইএস জঙ্গিরা গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছে। একদিন দুপুরের পর হঠাৎই নাগাড়ে গুলির শব্দ। পাহাড়ি গ্রামে যে যেদিকে পারছে ছুটছে। পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে উঠে ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা, অথবা পাহাড় পেরিয়ে মৃত্যুদূতদের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা। যাঁরা পারলেন, তাঁরা বেঁচে গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু আমি এই ছোট্ট মাস কয়েকের ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাব, কী করব বুঝতে বুঝতেই বন্দি হলাম। আমি এবং আমার পরিবারের ১০ জনকে একটি গাড়িতে গাদাগাদি করে তোলা হল।’’ — এখনও স্পষ্ট মনে আছে ফারিয়ালের।

আইসিস জঙ্গিদের কবল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এভাবেই ঘরে ফিরছেন ইরাক ও সিরিয়ার বাসিন্দারা।

আর জঙ্গি ডেরায় পৌঁছানোর পর? ফারিয়ালের কথায়, ‘‘জঙ্গিদের দলে এক জনকে সবাই আবু কাত্তাব বলে ডাকছিল। সেই ছিল সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর, কঠোর অত্যাচারী। আমার স্বামী হোশিয়ারকে এমন মেরেছিল, যে তাঁর উঠে বসার ক্ষমতা ছিল না। আর অন্য একজন আমার ছেলেকে কোল থেকে নিয়ে ওর হাতটা গরম জলে চুবিয়ে দিল। চোখের সামনে ওই দৃশ্য দেখে যে কী ভাবে বেঁচে ছিলাম, এখন ভাবলেও শিউরে উঠি। ওর চুল কেটে দেওয়া হল, ভয়ে ওইটুকু ছেলেরও কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, থেমে গিয়েছিল হাসি।’’

আরও পডু়ন: পাকিস্তানের ডিগবাজি! জঙ্গি ডেরা নয় মাদ্রাসা, জইশ সদর কার্যালয়ের দখল নিয়েও ক্লিনচিট

ফেরার গল্পটা আরও ভয়াবহ। ধরা পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি। তবু মনের জোরকে সম্বল করেই পাঁচ বার পালানোর চেষ্টা করেছেন ফারিয়াল। কিন্তু প্রতি বারই কোনও না কোনও ভাবে থেমে গিয়েছে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা। অবশেষে গোপনে যোগাযোগ হয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে। তখনই শুরু হয় স্বাধীনতার যাত্রা, জানালেন ফারিয়াল। তাঁর কথায়, ‘‘মার্কিন হানায় আইএস জঙ্গিরা কোণঠাসা। জঙ্গিদের অনেকেই তখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন। তারাই আমাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। তাতেই খুলে যায় মুক্তির পথ।’’

ফারিয়াল বলেন, ‘‘দুপুর আড়াইটেয় বোঘাউজ থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। অজানা পথের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম আমরা তিন জন। দু’দিন ধরে টানা হাঁটার পর রাত আটটায় হঠাৎই দেখলাম আকাশ থেকে আলোর ঝলকানি নেমে আসছে। মার্কিন সেনা আকাশ থেকে আক্রমণ করছিল। আবার স্থলপথেও এগিয়ে যাচ্ছিল মার্কিন সেনা। জঙ্গিরা আকাশের দিকে হাত তুলে ক্ষমা প্রার্থনা করছিল। আর বলতে চেষ্টা করছিল, ইয়াজিরিদের ওরা রক্ষা করেছে। কিন্তু তাদের কথায় কান না দিয়ে ওদের যুদ্ধবন্দি করল। আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। আর অবশেষে পৌঁছলাম আমুডায়।’’

যাত্রাপথের বর্ণনায় ফারিয়াল বলেছেন, ‘‘ঘুটঘুটে অন্ধকারেও হাঁটার সময় পায়ে পায়ে টের পেয়েছি লাশের ছড়াছড়ি। সেসব পাশ কাটিয়ে হেঁটেই চলেছি নতুন সূর্যোদয়ের আশায়, অজানা এক পথ ধরে, অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশে।ছেলেকে কখনও কোলে নিয়ে, কখনও ওর বাবার কোলে দিয়ে, কখনও হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছি। মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠেছে এখন বছর পাঁচেক বয়সের এই ছেলে। (সংবাদ সংস্থাকে সাক্ষাৎকারের সময় সঙ্গেই ছিল তাঁর ছেলে)। কখনও মুখ চেপে, কখনও ফিসফিস করে ছেলেভোলানো কথা বলে থামিয়েছি। একটা সময় ওর চোখ থেকে শুধুই জল গড়িয়ে পড়েছে। বেরোয়নি কান্নার শব্দ। আর চলতে চলতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তখন শুয়ে পড়েছি সেখানেই। খোলা আকাশের নীচে। জন্তু জানোয়ারের ভয়, তীব্র ঠান্ডার কাঁপুনি সব উবে গিয়েছিল মুক্তির নেশায়।’’

ফারিয়ালের মতো জঙ্গি ডেরা থেকে ফেরা অন্য অনেক আই এস জঙ্গিদের নির্যাতনের কথা বলেছেন। বিছানার সঙ্গে বেঁধে, কী ভাবে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হত তাঁদের, কী ভাবে প্রতিদিন বদল হত মালিক— সে সব কথা অনেকেই বলেছেন। আবার অপহৃত মহিলাদের একটা বড় অংশই আত্মহত্যা করতেন, সে সবও এখন অজানা নয়। কিন্তু ফারিয়াল আর সে সব কথা মনে করতে চান না। শুধু বললেন, ‘‘ওই সময় কী মনে হত, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু একটাই প্রার্থনা করতাম, এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই। ’’

পাঁচ বারের যে পালানোর কথা বলেছেন, তার মধ্যে এক বারের কথা শোনাতে গিয়ে ফারিয়াল বলছিলেন, ‘‘২০১৭ সালে ধরা পড়ার পর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল কয়েক গুণ। খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী, টয়লেটে যাওয়াও বন্ধ করে দিযেছিল তখনকার সেই মালিক। কিন্তু জানতাম প্রতিবাদ করলেই ছেলে আর স্বামীকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে দেবে ওরা। হয়তো বা মেরেও ফেলবে। তাই চুপচাপ সব সহ্য করেছি।

(সারা বিশ্বের সেরা সব খবর বাংলায় পড়তে চোখ রাখতে পড়ুন আমাদের আন্তর্জাতিক বিভাগে।)

ISIS Iraq Syria
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy