শুক্রবার জুম্মার নমাজের পরে লাল পতাকা ওড়ানো হয়েছিল জ়ামকারান মসজিদের চূড়ায়। লাল পতাকা উড়তেই যুদ্ধের আভাস মিলে গিয়েছিল। সেই মতো শনিবার ইজ়রায়েলে প্রত্যাঘাত করল ইরান। ‘লৌহজাল’ ভেদ করে একের পর এক ইরানীয় ক্ষেপণাস্ত্র গিয়ে পড়ল ইজ়রায়েলের রাজধানী তেল আভিভে। ইজ়রায়েলের অপারেশন ‘রাইজ়িং লায়ন’-এর পাল্টা ইরানের ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস ৩’ অভিযানে প্রাণ গেল তিন জনের। জখম অন্তত ৪০।
এর পাশাপাশিই চলছে হুমকির লড়াই। শুক্রবার ইজ়রায়েলি হামলার পর প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দিয়েছিল তেহরান। শনিবার তারা আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকেও হুমকি দিয়েছে। বলেছে, ইজ়রায়েলকে সাহায্য করলে তাদের সামরিক ঘাঁটিতেও হামলা হবে। রবিবার ওমানে আমেরিকার সঙ্গে যে বৈঠক হওয়ার কথা, তাতেও ‘না’ বলে দিয়েছে ইরান। সেই আবহে ইজ়রায়েলও তাদের হুমকি দিয়ে রেখেছে— ‘‘এখনই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা না থামালে জ্বালিয়েপুড়িয়ে খাক করে দেব।’’
শুক্রবার রাত থেকেই ইজ়রায়েলে হামলা চালাতে শুরু করে ইরান। তেহরানের একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়েছে তেল আভিভের দক্ষিণে। সেখানকার তিন জনপদ দ্য কিরইয়া, রমাত গান এবং রিশন লেজ়িয়নে গিয়ে পড়েছে সেই ক্ষেপণাস্ত্র। এই জনপদগুলির মধ্যে দ্য কিরইয়া ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনীর কাছে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখানেই রয়েছে ইজ়রায়েলের সেনাবাহিনী আইডিএফ-এর সদর দফতর। শুক্রবার রাতে এই দফতরের খুব কাছেই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র গিয়ে পড়ে। রমাত গান এবং রিশন লেজ়িয়নে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হানায় ভেঙে পড়েছে বহুতল আবাসনের একাংশ।
ইজ়রায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, শুক্রবার রাতে ইরান ১০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলের দিকে। ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র এফি ডিফ্রিন বলেন, “ইরানের যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, তার ধ্বংসাবশেষ উড়ে এসেই যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে।” শনিবার ভোরেও ইজ়রায়েলের উত্তরাংশকে নিশানা করে ক্ষেপণাস্ত্র হানা চালায় ইরান। নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হানার আশঙ্কায় উত্তর ইজ়রায়েলের বিভিন্ন প্রান্তে শনিবার সকাল থেকেই বেজে উঠেছে এয়ার সাইরেন। ইজ়রায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমিতেও এয়ার সাইরেনের শব্দ শোনা গিয়েছে। স্থানীয়দের নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ইজ়রায়েল প্রশাসন।
পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলও। এখনও পর্যন্ত ইজ়রায়েলি হানায় ইরানে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৩২০ জন। শনিবার এই তথ্য জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জে ইরানের দূত।
সংঘাতের আবহে ইরান জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমেরিকার সঙ্গে বৈঠকে বসাও অর্থহীন। ইরানের বিদেশ দফতরের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই বলেছেন, ‘‘এক পক্ষ (আমেরিকা) এমন আচরণ করছে যে, আলোচনা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। আপনি একই সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে চান, আবার ইজ়রায়েলকে ইরানের ভূখণ্ডে আক্রমণ করার সুযোগ করে দিতে চান— দুটো একসঙ্গে হতে পারে না।’’
বস্তুত, সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতির জন্য আমেরিকাকেই দায়ী করেছে ইরান। দিয়েছে হুমকিও। তেহরান জানিয়ে দিয়েছে, শুধু ইজ়রায়েলেই নয়, পশ্চিম এশিয়ায় থাকা আমেরিকার ঘাঁটিগুলিতেও হামলা হবে। সংবাদমাধ্যম আল জাজ়িরার এক প্রতিবেদন অনুসারে, পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে (মিশরের লোহিত সাগর তীরবর্তী অঞ্চল-সহ) অন্তত ১৯টি জায়গায় আমেরিকার সামরিকবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি জায়গায় আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু জায়গায় আমেরিকার সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। বাহরিন, মিশর, ইরাক, জর্ডন, কুয়েত, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে এই ঘাঁটিগুলি রয়েছে।
কী বলছে বিভিন্ন দেশ
ইরানের উপর ইজ়রায়েলি হানার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ৯ দেশের মিলিত মঞ্চ সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন (এসসিও)। এই আন্তর্জাতিক মঞ্চের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারত এবং ইরান উভয়েই রয়েছে। তবে এসসিও-র বিবৃতির থেকে দূরত্ব রেখে পৃথক ভাবে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে নয়াদিল্লি। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক এ-ও জানিয়ে দিয়েছে, এসসিও-র বিবৃতি নিয়ে কোনও আলোচনায় ভারত যোগ দেয়নি। বস্তুত, ভারতের সাত বাক্যের ওই বিবৃতিতে ইজ়রায়েলি হানার নিন্দা করে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। এসসিও-র সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারত, ইরান ছাড়াও রয়েছে চিন, কাজ়াখস্তান, কিরগিজ়স্তান, রাশিয়া, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং উজ়বেকিস্তান। এসসিও-র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতি অনুসারে, অসামরিক নিশানায় এই ধরনের আক্রমণের ফলে অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের পরিপন্থী। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এই হামলা ইরানের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করে। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। এসসিও-র এই বিবৃতিটি প্রকাশ্যে আসার পরেই ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক থেকে সাতটি বাক্যে পৃথক একটি বিবৃতি প্রকাশ করে ইজ়রায়েল-ইরান সংঘর্ষ নিয়ে নয়াদিল্লির অবস্থান স্পষ্ট করা হয়। বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, ইজ়রায়েল এবং ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে এসসিও একটি বিবৃতি জারি করেছে। এ বিষয়ে ভারত শুক্রবারই নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেছে এবং এখনও সেই অবস্থানেই রয়েছে। আলোচনা এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইজ়রায়েল এবং ইরানকে সংঘর্ষ থামানো জন্য আহ্বান জানিয়েছে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলিরও এই লক্ষ্যেই চেষ্টা চালানো উচিত বলে মনে করছে ভারত। বিদেশ মন্ত্রক আরও জানিয়েছে, শুক্রবারই ইরানের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। সংঘর্ষের পথ থেকে পিছিয়ে এসে দ্রুত কূটনৈতিক স্তরে বিষয়টি দেখার জন্যও ইরানি বিদেশমন্ত্রীকে প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
ভারতের ভুল মানচিত্র
ইরানে হামলার কারণ বোঝাতে গিয়ে সমাজমাধ্যমে একটি মানচিত্র পোস্ট করেছিল ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)। কিন্তু সেখানে ভারতের ভুল মানচিত্র দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ। পাক অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরকে সেই মানচিত্রে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হিসাবে দেখানো হয়েছে। আইডিএফ এই পোস্ট করার পর থেকেই বিতর্ক দানা বেঁধেছে। ভারতের বহু ব্যবহারকারী ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সমাজমাধ্যমে। কেউ ইজ়রায়েলের ওই পোস্টের নীচেই ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। কেউ আবার খোদ ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে উল্লেখ করে মানচিত্র নিয়ে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। বিতর্ক ক্রমেই বাড়ছিল। অবশেষে এই মানচিত্রে ত্রুটি আছে বলে স্বীকার করে নেয় আইডিএফ। ক্ষমাও চাইতে হয়েছে তাদের।
নিহত ন’জন পরমাণু বিজ্ঞানী
ছ’জন নয়। ইরানের মোট ন’জন পরমাণু বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ নিহত হয়েছেন ইজ়রায়েলি হামলায়। সংঘর্ষের আবহে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে ইজ়রায়েল। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দেশের নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, ইরানের যে ন’জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত, তাঁরা হলেন— নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ ফেরেদুন আব্বাসি, আহমেদ রেজ়া জ়োলফাঘরি দোরিয়ানি, পদার্থবিদ্যার বিশেষজ্ঞ মহম্মদ মেহদি তেহরানচি, আমির হাসান ফাখাহি, মনসুর আসগারি, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিশেষজ্ঞ আকবর মোতালেবি জ়াদেহ, মেটেরিয়াল্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিশেষজ্ঞ সইদ বর্জি, রিয়্যাক্টর ফিজ়িক্সের বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলহামিদ মিনৌশেহর এবং মেকানিক্সের বিশেষজ্ঞ বখৌয়েই কাতিরিমি। ২০২০ সালে খুন হয়েছিলেন ইরানের পরমাণু গবেষণার ‘জনক’ মোহসেন ফাখরিজ়াদেহ। দাবি, ইজ়রায়েলই তাঁকে খুন করেছিল। সদ্য হামলায় নিহত ন’জন সেই মোহসেনেরই উত্তরসূরি বলে দাবি ইজ়রায়েলের। তেল আভিভের সেনা জানিয়েছে, গত এক বছর ধরে ওই পরমাণু বিশেষজ্ঞদের সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করা হয়েছিল। তাঁদের উপর নজর রাখছিলেন কড়া গুপ্তচরেরা। তাঁরা কোন প্রকল্পে কাজ করছেন, কোথায় যাচ্ছেন, সব খবরাখবর সংগ্রহ করতেন তাঁরা। সেই সব তথ্যের ভিত্তিতে ছক কষে ন’জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইজ়রায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী।
পরমাণুকেন্দ্র মূলত অক্ষত?
ইজ়রায়েলি হানার পরে পরমাণুকেন্দ্র মোটের উপর অক্ষতই রয়েছে বলে দাবি ইরানের। শুক্রবার ইরানের বৃহত্তম পরমাণুকেন্দ্র লক্ষ্য করে বিমানহানা চালায় ইজ়রায়েল। তার পর থেকেই ওই পরমাণুকেন্দ্রের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ দানা বাঁধতে শুরু করে। যদিও ইরানি পরমাণু সংস্থার দাবি, ফোরডোয় ওই পরমাণুকেন্দ্রে সামান্যই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইরানি সংবাদ সংস্থা আইএসএনএ-কে এমনটাই জানিয়েছেন সে দেশের পরমাণু সংস্থার এক মুখপাত্র।
ইরানের কাসিম বশির
মাত্র এক মাসে আগেই তেহরান প্রকাশ্যে এনেছিল তার নতুন অস্ত্র। শুক্রবার গভীর রাতে সেই মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কাসিম বশির ব্যবহার করেই তারা ইজ়রায়েলের তেল আভিভে সফল হামলা চালিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পাল্লার কঠিন জ্বালানি-চালিত কাসিম বশির ক্ষেপণাস্ত্র গত মে মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে ইরান ফৌজের এলিট ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড অ্যারোস্পেস ফোর্স’-এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ় নাসিরজাদে। বস্তুত, এটি ইরান ফৌজের গত এক দশক ধরে ব্যবহৃত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হজ কাসিমের উন্নততর সংস্করণ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সে সময়ই আজিজ় দাবি করছিলেন, ইজ়রায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ (লৌহজাল) ভেদ করতে সমর্থ হবে কাসিম বশির।