Advertisement
E-Paper

কাঁপল হিন্দুকুশ, বিজ্ঞানীদের মতে শাপে বর

পর পর চার দিনে চারটে! সেখানেই যে ইতি পড়বে, তেমন নিশ্চয়তাও নেই। শনি, রবি— দু’দিন দু’টি ভূমিকম্প কেন্দ্রীভূত হয়েছিল নেপালে। সোমবার তৃতীয়টি দানা বাঁধে নেপাল-ভারত সীমান্তে, পশ্চিমবঙ্গের মিরিকের কোল ঘেঁষে। তার পরে মঙ্গলবার কাঁপল পাকিস্তান। যদিও তাতে ক্ষয়ক্ষতির কোনও খবর নেই।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৮

পর পর চার দিনে চারটে! সেখানেই যে ইতি পড়বে, তেমন নিশ্চয়তাও নেই।

শনি, রবি— দু’দিন দু’টি ভূমিকম্প কেন্দ্রীভূত হয়েছিল নেপালে। সোমবার তৃতীয়টি দানা বাঁধে নেপাল-ভারত সীমান্তে, পশ্চিমবঙ্গের মিরিকের কোল ঘেঁষে। তার পরে মঙ্গলবার কাঁপল পাকিস্তান। যদিও তাতে ক্ষয়ক্ষতির কোনও খবর নেই।

এবং এ দিন দুপুরে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাসে হিন্দুকুশ পাহাড়ে ৫.৫ রিখটার মাত্রার ওই ভূকম্পে অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না ভূ-বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, শনিবার নেপালের তীব্র ভূমিকম্পের জেরে তামাম হিমালয় অঞ্চলের ভূস্তরে দু’টি টেকটোনিক প্লেটের মধ্যবর্তী চ্যুতি (হিঞ্জ) ও খোঁচাগুলির ভারসাম্য যে ভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, তাতে এমনটা হওয়ারই কথা ছিল। শুধু তা-ই নয়, ওই তল্লাটে আগামী ক’দিনে পর পর কয়েকটি মাঝারি বা বড় মাত্রার (৫-৬ রিখটার) ভূকম্পের সম্ভাবনাও থাকছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ।

এ দিকে ভূ-পদার্থবিদদের সামনে গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে নেপাল-কাণ্ড। শনিবারের ভূমিকম্পে নেপালের ভূগর্ভে কোনও স্থায়ী পরিবর্তন হল কি না, সে সম্পর্কে নানা মতবাদ বেরিয়ে আসছে। যেমন কেমব্রিজ, ডারহাম ও অ্যাডিলে়ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞেরা দাবি করেছেন, শনিবারের ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের তেজে কাঠমান্ডু দক্ষিণ দিকে কিছুটা সরে গিয়েছে। কারও কারও ধারণা, সরণের পরিমাণ অন্তত তিন মিটার। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষকের আবার দাবি: শনিবারের ভূমিকম্পে দু’টি টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনকালে বিহারের অনেকটা ঢুকে গিয়েছিল নেপালের নীচে।

যদিও তাতে নেপালের মানচিত্রের কোনও পরিবর্তন হবে কি না, ওঁরা তা বলতে পারেননি। এভারেস্টের অবস্থান বদলেছে বলেও ওঁরা মনে করেন না। কারণ, মাউন্ট এভারেস্টের নীচে কোনও খোঁচ বা চ্যুতি নেই।

অন্য দিকে ভারতীয় গবেষকদের একাংশের মতে, নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান পাল্টেছে কি না, ওত তাড়াতাড়ি তা বলা সম্ভব নয়। খড়্গপুর আইআইটি’র ভূকম্প-বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথের মন্তব্য, ‘‘গোটা অঞ্চলটির ভূগর্ভ এখন খুবই অস্থির। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে নতুন সমীক্ষা শুরু করা হবে। তখনই বোঝা যাবে, স্থায়ী পরিবর্তন কিছু হয়েছে কি না।’’ নেপালের ভূমিকম্পের জেরে যে ভাবে একের পর এক কম্পন হয়ে চলেছে, আইআইটি এবং জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র ভূ-বিজ্ঞানীদের নজর এখন মূলত তারই উপরে।

বস্তুত ভারতীয় ভূ-পদার্থবিদেরা বলছেন, গত বেশ ক’বছর ধরে গোটা হিমালয় এলাকায় ভূগর্ভের স্থিতিশীলতা নানা ভাবে ধাক্কা খেয়েছে। পরিণামে ইন্ডিয়ান টেকনোটিক প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেটের জোড়ে জোড়ে বিভিন্ন ছোট-বড় চ্যুতি ও খোঁচে জমেছে অতিরিক্ত শক্তি। উপরন্তু শনিবারের ভূমিকম্পের জেরে চ্যুতি-খোঁচগুলো নিজেদের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি।

কী ভাবে?

খড়্গপুর আইআইটি’র ভূকম্প-বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথের ব্যাখ্যা, যেখানে যেখানে সঞ্চিত শক্তির মাত্রা সহনসীমা (স্যাচুরেটেড পয়েন্ট) ছাড়িয়ে গিয়েছে, সেখানেই শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটছে। কেঁপে উঠছে মাটি।

প্রসঙ্গত, হিমালয় অঞ্চলে ভূস্তরীয় প্লেটগুলির মধ্যে প্রধান খোঁচ তিনটে— প্রধান কেন্দ্রীয় (মেইন সেন্ট্রাল), প্রধান প্রান্তীয় (মেইন বাউন্ডারি) ও পৃষ্ঠদেশীয় (ফ্রন্টাল)। শঙ্করবাবু জানাচ্ছেন, শনিবার ঝাঁকুনিটি হয়েছে প্রধান প্রান্তীয় খোঁচে। সেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনির চোটে অন্য দু’টোও টালমাটাল। তা ছাড়া শনিবারের ভূকম্পের ‘আফটারশক’ হয়েছে নয় নয় করে ৭৫টি!

সব মিলিয়ে হিমালয়ের ভূস্তরে এখন তুমুল অস্থিরতা। যার প্রভাবে তিনটে খোঁচই স্থিতাবস্থা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে। তাদের যে কোনও বিন্দু থেকে যখন-তখন অতিরিক্ত শক্তি বিচ্ছুরণ হতে পারে। অর্থাৎ, আরও ভূমিকম্পের সম্ভাবনা। তবে কোথায় কখন তেমনটি হবে, তার কোনও পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন শঙ্করবাবু।

তবে ভূ-বিজ্ঞানীরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, হিন্দুকুশে এ দিনের সাড়ে পাঁচ রিখটার-মাত্রার ভূমিকম্পটির রেশ টেনে পুরো এলাকা আরও বেশ কয়েক বার আফটারশকে কেঁপে উঠতে পারে। যদিও নগণ্য কম্পাঙ্কের সুবাদে তার কয়েকটি হয়তো টেরই পাওয়া যাবে না। আর আফটারশক বাদ দিয়েও ওই তল্লাটে সম্ভাব্য ছোটখাটো ভূমিকম্পগুলির কেন্দ্রস্থল ক্রমশ শনিবারের ভূকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে সরবে।

প্রসঙ্গত, রবিবার নেপালের ভূকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল প্রথমটির দেড়শো কিলোমিটার দূরে। সোমবারেরটি কেন্দ্রীভূত হয় প্রথমটির অন্তত সাড়ে চারশো কিলোমিটার ফারাকে। আর মঙ্গলবারেরটি আরও, আরও বহু দূরে।

এমতাবস্থায় আগামী ক’দিন ভূ-বিজ্ঞানীদের নজর আটকে থাকবে সিসমোগ্রাফে। তাঁদের দাবি: পরের পর ভূকম্পগুলি যত বেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, বেশি ব্যাপ্তি নিয়ে হবে, তত ভাল বোঝা যাবে, ভূস্তরের তিনটি খোঁচের ক্ষতি কতটা হল। নতুন কোনও খোঁচ বা চ্যুতি গজিয়ে উঠল কি না, তা নিয়েও সমীক্ষা হওয়াটা জরুরি।

পাশাপাশি হিমালয় অঞ্চলে ধারাবাহিক এই কম্পনপর্বের একটা ভাল দিকও আছে বলে অনেকের অভিমত। শঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘এখন হিমালয়ের তিনটি খোঁচে যত বেশি ভূমিকম্প হবে, তত মঙ্গল।’’ কেন?

আইআইটি’র ভূ-বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা: ‘‘নেপালের বড় ভূমিকম্পটির দরুণ অন্যান্য খোঁচ-চ্যুতিতে নাড়া পড়েছে। সেখানকার সঞ্চিত অতিরিক্ত সব শক্তি বাইরে বেরিয়ে এসেছে।’’ তাঁর দাবি, এ ভাবে শক্তি নির্গমনের মাধ্যমেই খোঁচ ও চ্যুতিগুলো স্থিতিশীল হয়ে যাবে। ভূমিকম্পের আশঙ্কা কমবে।

‘‘মানে, শাপে বর হবে।’’— মন্তব্য ওই ভূ-বিজ্ঞানীর।

hindukush tremor himalayan region unstable debdut ghoshthakur seismograph hindukush earthquake geologist opinion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy