পালাবদলের বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে চর্চার বিষয় দলবদ্ধ সন্ত্রাস, যার পোশাকি নাম ‘মব সন্ত্রাস’। রাজপথ থেকে অলিগলি সর্বত্রই এ এক ত্রাস! এ থেকে রেহাই নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিরও। শিক্ষাবিদদের বড় অংশের মতে, এই দলবদ্ধ সন্ত্রাস দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ডকেই চুরমার করে দিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রগুলি কার্যত পরিণত হয়েছে ‘মবের মুলুকে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়— ‘জাতির বিবেকের বাতিঘর’ বলে পরিচিত। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ জন শিক্ষক মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। দাবি ছিল, এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কার্যকর এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ওই ৭১ জন শিক্ষককে কার্যত কাঠগড়ায় তুলেছে মব-বাহিনী। বিএনপি সমর্থিত অধ্যাপকদের সংগঠন সাদা দল দাবি করেছে, শেখ হাসিনার দোসর ওই ৭১ জন। সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেছিলেন, “গত ৩ আগস্টের আন্দোলনে শেখ হাসিনার নির্দেশে শিক্ষার্থীদের উপর যারা হামলায় সহায়তা করেছিল, তারাই আজ বিবৃতি দিচ্ছে। আমরা এ সব দোসরদের চিহ্নিত করে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছি।”
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, এর পর থেকেই ওই ৭১ জন অধ্যাপক-অধ্যাপিকাকে কার্যত ‘গণশত্রুতে’তে পরিণত করা হয়েছে। ওই ৭১ জনকে বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ছাত্রদের একাংশ। পড়ুয়াদের ওই অংশটিই বিশ্ববিদ্যালয়ে মবের নেতৃত্ব দেয় বলে খবর। ওই ৭১ জনের মধ্যে না থাকা এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘‘ক্লাসগুলিতে পড়ানোর পরিবেশ নেই। ইতিহাস, সাংবাদিকতা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসগুলিতে হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে। গত ১৫-১৬ বছরের কোনও উদাহরণ দিতে গেলেই রে রে করে উঠছে এক দল পড়ুয়া। শুরু হয়ে যাচ্ছে হইহট্টগোল।’’ তিনি জানিয়েছেন, অনেক সময় সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক-অধ্যাপিকাকে সমাজমাধ্যমে কুৎসিত আক্রমণ করা হচ্ছে। দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘ফাসিস্তের দোসর’ বলে। এমনকি, অনেক সময় ওই অধ্যাপক-অধ্যাপিকার বাড়িতে চড়াও হচ্ছে ছাত্র-জনতা। লাঞ্ছনা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না অধ্যাপকদের পরিবারের সদস্যরাও।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিও এক। আক্ষেপের সুরে এক অধ্যাপক জানিয়েছেন, এখন আর ‘মাস মিডিয়া বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশেরইতিহাস’ পড়ানো যাচ্ছে না। ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের মতো শব্দগুলিও যেন শ্রেণিকক্ষে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে অধ্যাপকদের বড় অংশের মতে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মব সন্ত্রাস যারা চালাচ্ছে, তাদের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ পড়ুয়াই পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু সন্ত্রাসকারীরাযে হেতু প্রচ্ছন্ন ভাবে প্রশাসনের সমর্থনপুষ্ট (অভিযোগ, মব সন্ত্রাসকারীদের নাকি টাকাও দেওয়া হচ্ছে), তাই তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কেউ পায় না।
এক অধ্যাপক জানিয়েছেন, ঢাকা শহর থেকে এক প্রিন্সিপালকে গ্রামের এক কলেজে বদলি করা হয়েছিল। তাঁকে সেই গ্রামের কলেজে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের কাছ থেকেও তিনি কোনও সাহায্য পাননি।
গণঅভ্যুত্থানের পর একযোগে সরকারি ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রায় ৮০টি কলেজের অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক হুমকি, বিক্ষোভ কিংবা শিক্ষার্থী ও ‘নতুন বিপ্লবী সংগঠনের’ চাপ প্রয়োগ করে এসব ঘটানো হয়। শিক্ষার প্রাঙ্গণে কেন এই পরিস্থিতি? শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মুহাম্মদ ইউনূস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছাত্ররা তাঁদের (উপদেষ্টা পরিষদ) প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। তারা যখন বলবে, তখন তাঁরা চলে যাবেন। সেই কারণেই কিপ্রশাসন কোনও পদক্ষেপ করছে না? সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রে উত্তর সম্পাদকীয়তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা জোবাইদা নাসরীন লিখেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, এখনও পর্যন্ত কেউবিশেষ করে সরকারের ওপর মহল ছাত্রদের লেখাপড়ায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়নি। কেন যেন সবাই চায়, ছাত্ররা রাস্তায় থাকুক’।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)