Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ধ্বংসনগরী ছাড়ার হিড়িক

ফের ব্যস্ত তাঁবুর শহর। লাশের স্তূপ ফেলে রেখে এ বার নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে শহর ছাড়ার হিড়িক। রাতারাতি যেন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে কাঠমান্ডু। শনিবার থেকে টানা দু’দিন এখানেই যত্রতত্র তাঁবু খাটিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন কয়েক লক্ষ শহরবাসী। দিনের আলো ফুরোলেই ভুতুড়ে রাত। আলো নেই, জল-খাবার নেই, ধুলোয় ভারী বাতাসে শ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর।

আতঙ্কের দৌড়। ধস নামছে কালিখোলায়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

আতঙ্কের দৌড়। ধস নামছে কালিখোলায়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৫
Share: Save:

ফের ব্যস্ত তাঁবুর শহর। লাশের স্তূপ ফেলে রেখে এ বার নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে শহর ছাড়ার হিড়িক।

রাতারাতি যেন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে কাঠমান্ডু। শনিবার থেকে টানা দু’দিন এখানেই যত্রতত্র তাঁবু খাটিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন কয়েক লক্ষ শহরবাসী। দিনের আলো ফুরোলেই ভুতুড়ে রাত। আলো নেই, জল-খাবার নেই, ধুলোয় ভারী বাতাসে শ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর। তবু প্রাণপণ তাঁবুর মধ্যেই ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। সোমবারই তাঁদেরই একটা বড় অংশকে দেখা গিয়েছে কাচ্চা-বাচ্চা কোলে নিয়ে শহর ছাড়তে।

পর পর দু’দিন বিপর্যয়ের পর এ দিন সকালে অবশ্য বৃষ্টি থামে কয়েক ঘণ্টার জন্য। বিকেলের পরে ফের শুরু হয়। সন্ধে ৬টা নাগাদ নতুন একটি ভূকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫.১। উৎসস্থল, ভারত-নেপাল সীমান্তে মিরিকের কাছে। পরে আরও একটি কম্পন। শনিবারের ভূমিকম্পে নেপালে মৃতের সংখ্যা এরই মধ্যে ৪,০০০ ছাড়িয়েছে। আহতের সংখ্যা অন্তত ৭ হাজার। কাঠমান্ডু তো বটেই কোনও জেলা-হাসপাতালেও জায়গা নেই। জরুরি ভিত্তিতে অস্থায়ী তাঁবুই হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

রবিবার থেকেই দেশ জুড়ে বহু পেট্রোল পাম্প বন্ধ। ঝাঁপ পড়তে শুরু করেছে ওষুধের দোকান থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানেও। এতে আগামী দিনে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রশাসন।

এখনও পর্যন্ত শুধু কাঠমান্ডুতেই মারা গিয়েছেন অন্তত ১৬০০ মানুষ। নিখোঁজ বহু। যত সময় গড়াচ্ছে, কাঠমান্ডু লাগোয়া বিভিন্ন জেলা থেকেও শ’য়ে শ’য়ে প্রাণহানির খবর আসছে। রবিবার পর্যন্ত শহর জুড়ে রাস্তার উপর সার দেওয়া লাশের স্তূপ চোখে পড়েছিল। সোমবার প্রশাসনের উদ্যোগেই গণসৎকারের আয়োজন করা হয়। বাগমতি নদীর সব ঘাটেই এ দিন ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যস্ততা শহর থেকে পালাতে চেয়েও।

কিন্তু পালাতে পালাতে কত দূর? উত্তর দিলেন কুষ্ণ মুক্তারি। মুদির দোকান চালাতেন শহরে। ভূমিকম্পে দোকান-বাড়ি সব খুইয়েছেন। বললেন, ‘কোন ভরসায় থাকব বলুন? বাচ্চা রয়েছে। ওদের নিয়ে তো আর রাতে টানাহেঁচড়া করা যায় না!’’

পালাতে চাইছেন কাঠমান্ডুর বাসিন্দা পাসাং শেরপা-ও। বেঁচে থাকা প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁবুতেই কাটিয়েছেন দু’রাত। শনিবারের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা এখনও ভুলতে পারছেন না। এ দিন টেলিফোনে আনন্দবাজারকে জানালেন, ‘‘বছর দেড়েকের ছোট মেয়েটাকে কোলে বসিয়ে তখন দুধ খাওয়াচ্ছিল ওর মা। সিঁড়িতে লুকোচুরি খেলছিল ছেলে দু’টো। হঠাৎ কাঁপুনি। প্রথমটায় বুঝিনি ভাল করে। একটা ছেলে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল। ওকে সামলাতে গিয়ে ফের কাঁপলাম। মাটিটা সমানে দুলছিল, দাঁড়াতে পারছিলাম না। তখনই বুঝেছিলাম, যে করেই হোক পালাতে হবে।’’ বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরোতে না বেরোতেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে বাড়ি। দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন তিনিও।

তবে আন্তর্জাতিক সাহায্য আসতে শুরু করেছে। চিন, পাকিস্তানের মতো এগিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও আমেরিকা।

চিন্তিত ভারত-ও। এ দিনও সরকারের শীর্ষ কর্তারা পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেছেন। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও অফিসাররা ফের আলোচনায় বসেন। সেখানে আগামী দু’দিনের পথনির্দেশিকা নিয়ে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী-সহ লোকসভার সমস্ত সদস্য তাঁদের এক মাসের বেতন নেপালের ত্রাণ তহবিলে দান করবেন।

রবিবারের ১৩টি আর সোমবার সারা দিনে ৯টি ত্রাণবোঝাই সামরিক বিমান নেপালে পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর তিনটি প্রতিনিধি দল নেপালে পৌঁছে গিয়েছে। এ দিন প্রতিরক্ষা, বিদেশ, এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যৌথ সাংবাদিক সম্ম‌েলনে জানানো হয়েছে, চাপ বাড়ছে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে। তাই ভারতীয় বিমানগুলি (৪টি অসামরিক বিমানও এ দিন গিয়েছে আটক ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার জন্য) কাঠমান্ডুতে না নামিয়ে পোখরায় নামানো হয়েছে। সঙ্গে ত্রাণবোঝাই ৮টি হেলিকপ্টার এবং ১৬০টি বাস কাঠমান্ডু পাঠানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE