২০ বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, এই তো সে দিনের কথা। ফাইল চিত্র
২০০০ সালের শেষ দিকে এক বার আমেরিকা গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পরে আবার ২০০১ সালের এপ্রিলের শুরুতে যাই। তখন ইনফোসিসে চাকরি করতাম। সপ্তাহদুয়েক নিউ ইয়র্কে ছিলাম। তার পরে নিউ জার্সির প্লেনসবরো শহরে থাকতে শুরু করি।
প্রতি দিন প্লেনসবরো থেকে প্রিন্সটন জংশনে যেতাম গাড়িতে। সেখান থেকে ট্রেন ধরতাম। দু’রকম ট্রেন পাওয়া যেত। এনজে ট্রানজ়িট। কখনও অ্যামট্র্যাকও (সুপারফাস্ট ট্রেন) ধরতাম। সেটায় চেপে নিউ জার্সির কাছে জার্সি সিটিতে, ওখানে নেমে পাথ (পোর্ট অথরিটি ট্রান্স হাডসন)-এর ট্রেন। ভূগর্ভস্থ টানেল দিয়ে গিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার ওয়ানের নীচের স্টেশনে নামতাম। মিনিট দশেক হেঁটে ওয়াল স্ট্রিট ধরে ওয়ান নিউ ইয়র্ক প্লাজ়ায়। প্লাজ়ার ৩৮ তলায় আমার অফিস।
প্লেনসবরো থেকে ইনফোসিসের এক সহকর্মী-সহ ৪-৫ জনের দল ছিল আমাদের। রোজ একসঙ্গে ট্রেনে যেতাম। ওই দলে এক জন আমেরিকানও ছিলেন। কাজ করতেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে।
১১ সেপ্টেম্বর অ্যামট্র্যাকের ট্রেনটা মিস করেছিলাম। বাকিদের বললাম, তোমরা চলে যাও। তখন আফসোস করছি, ইস্... একটুর জন্য ট্রেনটা ধরতে পারলাম না! ফলে জার্সি সিটিতে গিয়ে পাথের ট্রেনে উঠেছি। টানেলে ঢোকার আগে হাডসনের ও পাশে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার দেখা যেত। সে দিন টানেলে ঢোকার আগে হঠাৎই আটকে দেওয়া হল ট্রেন। বুঝতে পারছি না, কী হল। তখনই এক সহযাত্রীকে তাঁর বন্ধুর ফোন— ‘তোমরা এ দিকে এসো না।’ ফোন স্পিকারে ছিল। তখন সবে প্রথম প্লেনটা ধাক্কা দিয়েছে। ট্রেন থেকে দেখছি, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ট্রেনেও ঘোষণা হল, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে। অন্য ট্র্যাকে ঘুরিয়ে ট্রেন মিডটাউনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। গোটা ট্রেন স্তব্ধ। পিন পড়লেও যেন আওয়াজ পাওয়া যাবে।
কিছু ক্ষণ পরে ট্রেন ঘুরিয়ে দিল। অন্য একটা স্টেশনে নামলাম। দৌড়তে লাগলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দিকে। পথেই বিশাল আওয়াজ। মাটি কেঁপে উঠল। গিয়ে দেখি, তত ক্ষণে একটা টাওয়ার ভেঙে পড়েছে। তখন পৌনে ১০টা। চেষ্টা করলাম স্ত্রী মধুরিমাকে ফোন করতে। কিন্তু কানেকশনই নেই। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার থেকে তখন আমি ২০০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে। জায়গাটা ঘিরে দিয়েছে পুলিশ। ঘটনাস্থলে সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক, দমকলকর্মী, উদ্ধারকর্মীর ভি়ড়।
এক চিত্রসাংবাদিক চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওহ গড!’ বললাম, ‘‘কী হল? এক বার দেখতে দেবেন?’’ ক্যামেরার আইপিসে চোখ রাখতেই দেখি, ৯০ তলার উপর থেকে মানুষ বাঁচার আশায় ঝাঁপ দিচ্ছে। বুকটা কেঁপে উঠল। এ দৃশ্য কল্পনাতেও আসে না।
তার মধ্যেই দেখলাম, দমকলকর্মীদের একটা বড় দল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের অন্য টাওয়ারে ঢুকলেন। আর তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওই টাওয়ারটাও ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো। কয়েক সেকেন্ড সকলে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। চারপাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এ বার সকলে ছুটতে শুরু করলাম। কোথায় যাচ্ছি, কী ভাবেই বা যাব... ঠাওর করতে পারছি না। দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে দৌড়চ্ছি। ১০ মিনিট পরে যখন হাঁফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি, দেখছি পিছনে পুলিশও দৌড়চ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনারা দৌড়চ্ছেন কেন?’’ ওঁরা বললেন, ‘‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নীচে যে গ্যাস পাইপলাইন রয়েছে, সেখানে বিস্ফোরণ
হলে, গোটা এলাকা ধসে যাবে।’’
হঠাৎ শুনলাম, ‘অরিজিৎদা’! ঘুরে দেখি ইনফোসিসের সহকর্মী শমীক। দু’জনে দৌড়ে গেলাম সামনের জেটিতে। দেখি কাতারে কাতারে লোক। সকলেই বোট ধরতে মরিয়া। ভাবছি, এ ভাবে যেতে গেলে হয়তো ভিড়ের চাপেই মারা যাব। ঠিক করলাম, খেয়ে নিই। খুঁজে খুঁজে ম্যানহাটনের ভূগর্ভস্থ এক রেস্তরাঁয় ঢুকে খাওয়া-দাওয়া করলাম। ফোন বা টিভির কানেকশন কিচ্ছু নেই। কিন্তু লোকে বলাবলি করছে, হামলা হয়েছে পেন্টাগনে। বার বার ফোনে চেষ্টা করতে লাগলাম। ঘণ্টা দেড়েক পরে ফোনে পেলাম দিদিকে। ওকে বললাম, ‘‘মধুরিমা, বাবা-মাকে বল বেঁচে আছি।’’
তত ক্ষণে ঠিক করে ফেলেছি, কোথাও যাব না। এখানেই বসে থাকব। তখনও জেটিগুলোতে বিপুল জনস্রোত। এক বার তো মনে হল, সাঁতরে হাডসন নদী পেরোব। বিকেল সাড়ে ৩টে-৪টে নাগাদ ওখান থেকে বেরোলাম। তবে জেটিতে পৌঁছে দেখি, কিছুটা ফাঁকা। ৫টা নাগাদ নৌকায় হাডসন পেরোলাম। ওখান থেকে এনজে ট্রানজ়িট ধরে বাড়ি ফিরলাম সাড়ে ৭টা নাগাদ।
ওই ঘটনার প্রায় ২-৩ সপ্তাহ পরে অফিস যেতে শুরু করি। পরে দু’তিন বার তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও পড়েছি। ওই ঘটনার পরে অনেক কিছু বদলে গিয়েছিল। বহু দিন ভাল ভাবে ঘুমোতে পারিনি। প্রায়ই মাঝরাতে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যেত— একের পর এক টাওয়ারের ধসে পড়া, মানুষের মরিয়া ঝাঁপ, ধোঁয়া আর ধুলোর কুণ্ডলী...
আর? আমাদের দলের যে পাঁচ জন একসঙ্গে যেতাম, তাঁদের মধ্যে সেই আমেরিকান ভদ্রলোক আর ফেরেননি। অ্যামট্র্যাক পেয়েছিলেন বলে সে দিন অফিসে ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
আর? আমি বেঁচে গেলাম, ট্রেন মিস করেছিলাম বলে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy