Advertisement
E-Paper

ছাড়া পেয়েও বন্ধুদের হাত ছাড়েননি ফারাজ

অস্ত্র উঁচিয়ে তেড়ে আসা জঙ্গিটি তখন ছেড়ে দিয়েছে বছর কুড়ির যুবককে। হোলি আর্টিজানের রক্তাক্ত মেঝে পেরিয়ে হুড়মুড়িয়ে পালাচ্ছেন তাঁর মতো ছাড়া পাওয়া বাকি বাংলাদেশিরা।

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫৫
তারিশি জৈন, ফারাজ আয়াজ হুসেন ও অবিন্তা কবির

তারিশি জৈন, ফারাজ আয়াজ হুসেন ও অবিন্তা কবির

অস্ত্র উঁচিয়ে তেড়ে আসা জঙ্গিটি তখন ছেড়ে দিয়েছে বছর কুড়ির যুবককে। হোলি আর্টিজানের রক্তাক্ত মেঝে পেরিয়ে হুড়মুড়িয়ে পালাচ্ছেন তাঁর মতো ছাড়া পাওয়া বাকি বাংলাদেশিরা। কেউ বা থমকে দাঁড়িয়ে তাড়া মারছেন। কিন্তু এ কী? সাক্ষাৎ যমের হাত থেকে মুক্তি পেয়েও তো পালানোর লক্ষণ নেই তাঁর।

কারণ তত ক্ষণে চরম সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছেন ফারাজ আয়াজ হুসেন। মৃত্যু শিয়রে টের পেয়েও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বন্ধু তারিশি, অবিন্তাকে সঙ্গে না নিয়ে এক পা’ও নড়বেন না তিনি। শেষ অবধিও নড়চড় হয়নি সেই কথার। হিসেব মতোই সাহসের মাসুল দিতে হয়েছে জীবন দিয়ে। শনিবার সকালে তারিশি, অবিন্তার মতোই ফারাজের রক্তে ভেজা দেহটি উদ্ধার করে বাংলাদেশ সেনা।

ফারাজ আয়াজ হুসেন, অবিন্তা কবির, তারিশি জৈন — প্রায় সমবয়সি তিন বন্ধু। কেউ উনিশ, কেউ বিশ। বাবার কর্মসূত্রে ঢাকায় ফারাজদের সঙ্গে একই স্কুলে পড়তেন তারিশি। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য তিন জনেরই গন্তব্য ছিল আমেরিকা। ফারাজ, অবিন্তা পড়তে গিয়েছিলেন আটলান্টার ইমোরি ইউনির্ভাসিটিতে। অর্থনীতি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনির্ভাসিটিতে পড়ছিলেন তারিশি। ছুটিতে দেশে ফিরেই তাই আড্ডা মারতে এক হয় তিন মাথা। ঠিক হয়ে যায় জায়গাও। গুলশনের জনপ্রিয় হোলি আর্টিজান বেকারি। শুক্রবারের রাতের পর যে নামটা শুনলেও কেঁপে উঠছে ওপার বাংলা। বিপদ টের পেতে বাথরুমে গা ঢাকা দেন তিন জন। কিন্তু তা আর কত ক্ষণ? এক সময় ফারাজ-তারিশিদের নাগাল পেয়ে যায় জঙ্গিরা।

রাতভর গোলা-গুলি, অসহায়, নিরস্ত্র মানুষগুলোকে এক-এক করে গলা কেটে খুন— সাম্প্রতিক অতীতে এত বড় নিষ্ঠুরতার নজির দেখেনি বাংলাদেশ। অথচ অমানবিকতায় সেই ভয়াবহ মুহূর্তেই তৈরি হয়ে যায় বন্ধুত্বের এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। যার নায়ক সদ্য কুড়ির ফারাজ।

কী রকম? জীবিত অবস্থায় ফেরা পণবন্দিরা জানাচ্ছেন সে গল্প। ফারাজ বাংলাদেশি টের পেয়ে জঙ্গিরা এক সময় তাঁকে ছেড়ে দেয়। যদিও ছাড়া পায়নি অবিন্তা, তারিশি। কারণ, এক জন এসেছেন আমেরিকা থেকে। অন্য জন ভারতীয়। কিন্তু বন্ধুদের রেখে পালাতে চাননি ফারাজ। বারবার বলতে থাকেন, ‘‘আমার বন্ধুদের কী হবে। ওদের রেখে যাব না’’। মুক্তি পাওয়া বাকি বাংলাদেশিরা তাড়া লাগাতে থাকে তাঁকে। এই তো প্রাণ নিয়ে পালানোর সুযোগ। যদিও সে কথায় কান দেননি বাংলাদেশি ফারাজ। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ধরে থেকেছেন তাঁর ভিন্‌দেশি বন্ধুদের হাত।

শনিবার ভোর ছ’টা নাগাদ রেস্তোরাঁর ভিতর থেকে বাবা সঞ্জীব জৈনকে ফোন করে তারিশি। ‘‘বাবা জঙ্গিরা আমাদের ঘিরে ফেলছে। খুব ভয় করছে। বন্ধুদের সঙ্গে বাথরুমে লুকিয়ে রয়েছি। মনে হচ্ছে না এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারব। আমাদের প্রত্যেককে মেরে ফেলবে ওরা’’, আতঙ্কে কাঁপছিল তাঁর গলা। এ কী বলছে তারিশি! মেয়ের খবর নিতেই তো জঙ্গি হানার কথা জানা মাত্র সঞ্জীব ছুটে এসেছেন হোলি আর্টিজানে। কিন্তু বাবার আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়ে ফোনের ও দিকে তখন শুধুই গুলির শব্দ। ফের তারিশিকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেন সঞ্জীব। তত ক্ষণে ফোন ‘ডেড’। তবে কি বাথরুমের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ল জঙ্গিরা?

আশঙ্কা সত্যি করে এক সময় আসে দুঃসংবাদটা। রেস্তোরাঁয় তাণ্ডব চালানো জঙ্গিরা রেয়াত করেনি তাঁর একমাত্র মেয়েকে। বাকি ১৯ জনের মতোই ধারালো অস্ত্রের কোপে হত্যা করেছে তারিশিকে। একটি সূত্র জানাচ্ছে, মারার আগে শারীরিক অত্যাচারও করা হয় তাঁর উপর। সোমবার তাঁর মৃতদেহ বিমানে দিল্লি নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সেখান থেকে দেহ নিয়ে যাওয়া হবে ফিরোজাবাদে।

এই ছুটিতে বাবা-মা-দাদার সঙ্গে সেখানেই যাওয়ার কথা ছিল বছর উনিশের তারিশির। পাঁচ বছর আগে জৈনদের পারিবারিক ভিটে সুহাগনগরে শেষ গিয়েছিলেন তিনি। পড়শিরা জানান, সে বার সবার সঙ্গে ভাব জমে উঠেছিল মেয়েটার। একটা বড় সময় হংকং-সিঙ্গাপুরে কাটানো তারিশি সেখানকার লোডশেডিংয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন। সেই মেয়েটাই বাড়ি ফিরবে কফিনবন্দি হয়ে, মানতে পারছেন না কাকা-জেঠারা। পড়শি দেশের মাটিতে বাড়ির মেয়ের হত্যায় ক্ষোভও উগরে দিয়েছে জৈন পরিবার। ভারতীয় হওয়ার ‘অপরাধে’ যে দেশের মাটিতে মরতে হয়েছে তারিশিকে, সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য হোক চান না তাঁরা।

Terror attack
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy