শুক্রবার গভীর রাতে (ভারতীয় সময়) আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজ় শহরের অদূরে মার্কিন সেনাঘাঁটি ‘জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন’-এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকে বসেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দুই রাষ্ট্রনেতার তিন ঘণ্টার বৈঠকে (মধ্যাহ্নভোজের সময়টুকু ধরলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা) সাড়ে তিন বছরের ইউক্রেন যুদ্ধের বিরতি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ওয়াশিংটন-মস্কো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বরফ অনেকটাই গলেছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
পাশাপাশি, বৈঠকে ট্রাম্প-পুতিনের শরীরী ভাষায় স্পষ্ট হয়েছে, দীর্ঘ টানাপড়েন সত্ত্বেও তাঁদের ব্যক্তিগত সমীকরণ এখনও অটুট। মার্কিন সেনাঘাঁটির রানওয়েতে পুতিনকে স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন ট্রাম্প স্বয়ং। দু’জনে রেড কার্পেটের উপর পাশাপাশি হাঁটার সময় অতিথিকে স্বাগত জানাতে মাথার উপর উড়েছে মার্কিন স্টেল্থ বোমারু বি-২ স্পিরিট আর তার দোসর এফ-২২ যুদ্ধবিমান। ঘটনাচক্রে, বি-২ বোমারু ব্যবহার করেই সম্প্রতি ইরানের পরমাণু ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছিল মার্কিন বায়ুসেনা।
‘জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন’- এর রানওয়েতে পুতিন ও ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স।
অধিবেশন কক্ষ নয়, ট্রাম্প-পুতিনের আলোচনা রানওয়েতে দাঁড়ানো মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্যাডিলাক লিম্যুজ়িনে (সরকারি পরিভাষায় যার নাম ‘দ্য বিস্ট’) সওয়ার হওয়ার পরেই শুরু হয়েছিল বলে মস্কোর দাবি। গাড়িতে পাশাপাশি বসেছিলেন তাঁরা দু’জন। সেই একান্ত আলাপচারিতাতেই তৈরি হয়েছিল আলোচ্যসূচির রূপরেখা। বৈঠক ‘ফলপ্রসূ’ হয়েছে বলে দুই রাষ্ট্রনেতাই দাবি করেছেন। কিন্তু এই বৈঠকে এখনও চূড়ান্ত সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসেনি। বৈঠকের পরেই ট্রাম্প ফোন করেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কিকে। সোমবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জ়েলনস্কি বৈঠকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ঐকমত্যের রাস্তা খুলতে পারে বলে ওভাল অফিসের তরফে ইঙ্গিত মিলেছে।
‘থ্রি-অন-থ্রি ফরম্যাট’
‘এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন’-এ মূল বৈঠকে দুই রাষ্ট্রনেতার একান্ত বৈঠক হয়নি। সেখানে তাঁদের দু’জন করে সহযোগী হাজির ছিলেন। কুটনীতির পরিভাষায় একে বলে ‘থ্রি-অন-থ্রি ফরম্যাট’। ট্রাম্পের সঙ্গে ছিলেন মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিও এবং প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। অন্য দিকে, পুতিনের সফরসঙ্গী রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ক্রেমলিনে প্রেসিডেন্টের সহকারী ইউরি উশাকভ। আলোচনার পরে দুই রাষ্ট্রনেতার যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে যে ঘোষণা করা হয়েছিল, তার রূপরেখা তৈরির বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল চার সহযোগীর। ‘থ্রি-অন-থ্রি ফরম্যাট’ অনুসরণ করার ফলে মূল আলোচনার পথ মসৃণ হয়েছে বলে শনিবার রুশ সংবাদ সংস্থা ‘তাস’-কে জানিয়েছে ক্রেমলিন প্রেস সার্ভিস।
‘থ্রি-অন-থ্রি ফরম্যাট’- এর সহযোগীরা। ছবি: রয়টার্স।
পুতিনকে চিঠি ট্রাম্প-পত্নীর
আলাস্কার বৈঠকে যোগ দিতে আসা পুতিনকে শুক্রবার ব্যক্তিগত ভাবে চিঠি লিখেছেন আমেরিকার ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। স্বামী ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত দিয়েই সেই চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বৈঠক চলাকালীন মেলানিয়ার লেখা চিঠি পুতিনের হাতে তুলে দিয়েছেন ট্রাম্প। চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে খোলসা করে কিছু বলতে চায়নি হোয়াইট হাউস। তবে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদে দাবি, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে যে সমস্ত শিশুরা সমস্যায় পড়েছে, তাদের কথা লিখেছেন মেলানিয়া। যুদ্ধের জেরে দুর্দশাগ্রস্ত শিশুদের দিকে পুতিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
সোমবার জট কাটাবেন জ়েলেনস্কি?
পুতিনের সঙ্গে বৈঠক সেরেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কিকে ফোন করেন ট্রাম্প। সংবাদ সংস্থা এএফপি জানাচ্ছে, বৈঠকে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা জ়েলেনস্কিকে জানিয়েছেন ট্রাম্প। ওই সংবাদ সংস্থা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, সোমবারই ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন জ়েলেনস্কি। তার আগে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ়’-কে ট্রাম্প জানান, যুদ্ধবিরতি নিয়ে সিদ্ধান্ত এ বার জ়েলেনস্কির উপর নির্ভর করছে। তাঁকেই পরবর্তী পদক্ষেপ করতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত রুশ সেনাদের স্মৃতিসৌধে পুতিন। ছবি: রয়টার্স।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে জ়েলেনস্কির উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় দেখেছিল গোটা বিশ্ব। সেই দূরত্ব সরিয়ে মার্চের শেষে যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। যুদ্ধের পরিস্থিতি বলছে, গত দু’মাসে রুশ ফৌজের ধারাবাহিক অগ্রগতি হচ্ছে ডনেৎস্ক-ওল্ডবাস্ট এবং লুহানস্ক অঞ্চলে (যাদের একত্রে ডনবাস বলা হয়)। খেরসন এবং জ়াপোরিঝিয়া, খারকিভ, সুমি, মিকোলিভ এবং নিপ্রোপেট্রোভস্কের কিছু কিছু অঞ্চলও পুতিনসেনার দাপটে পিছু হটছে জ়েলেনস্কির বাহিনী। এই আবহে সোমবার যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে জ়েলেনস্কি কতটা অনড় থাকতে পারেন, তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে।
প্রকাশিত খবরে দাবি, জ়েলেনস্কি ছা়ড়াও ইউরোপের আরও তিন রাষ্ট্রপ্রধানকে ফোন করেন ট্রাম্প। তাঁরা হলেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ এবং জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎজ়। তা ছাড়াও ট্রাম্প ফোনে কথা বলেন আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটো-র মহাসচিব মার্ক রুট এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লেয়েনকে। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা ওই ফোন কথোপকথনে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের নির্যাস প্রত্যেককে আলাদা ভাবে জানান ট্রাম্প।
ছবি: রয়টার্স।
বরফ গলল বৈঠকে, স্বস্তি পুতিনের
চূড়ান্ত সমাধানসূত্র না বেরোলেও ট্রাম্প-পুতিন যে একে অপরের সম্পর্ক আরও মজবুত করতে আগ্রহী, শুক্রবার সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁরা। ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার উপর কঠোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার যে চিন্তাভাবনা করছিলেন, সেই পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখতে চান। অন্য দিকে, পুতিন শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইতিবাচক মনোভাবের প্রশংসা করে তিনি জানিয়েছেন, ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে যদি হোয়াইট হাউসে জো বাইডেনের বদলে ট্রাম্প থাকতেন, তা হলে যুদ্ধ বাধতই না।
আরও পড়ুন:
এর আগে ২০২১ সালের ১৬ অগস্ট, জেনিভায় বাইডেনের সঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বৈঠক করেছিলেন পুতিন। সেই ঘটনার চতুর্থ বর্ষপূর্তির ঠিক পরেই হল আলাস্কার বৈঠক। ‘তাস’ জানিয়েছে, পুতিনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে যুদ্ধবিরতি নিয়ে দ্বিতীয় বৈঠকে যোগ দিতে মস্কোয় আসতে পারেন ট্রাম্প। সেখানে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি আলোচনায় আসতে পারে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো প্রসঙ্গও।
আমেরিকার সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ, ইউক্রেনে হামলার জেরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে চাপের মুখে থাকা পুতিনের কাছে এই বৈঠক বড় প্রাপ্তি। কারণ, মাত্র দু’সপ্তাহ আগেই রুশ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভের বিরুদ্ধে ‘পরমাণু হামলার হুমকি’ দেওয়ার অভিযোগ তুলে রাশিয়ার উপকূলের কাছে মার্কিন পরমাণু অস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজ মোতায়েনের কথা জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। এই আবহে আলাস্কায় ট্রাম্পের মন জয়ে সাফল্য পেয়েছেন তিনি। পুতিনের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত রুশ সেনাদের স্মৃতিসৌধেও গিয়েছেন ট্রাম্প।