আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক হয়ে গিয়েছে। তবে ইউক্রেনে শান্তিস্থাপনের বিষয়টি এখনও অধরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে? এই নিয়েই এখন জল্পনা তুঙ্গে। কূটনৈতিক মহল মনে করছে, এই যুদ্ধের দু’টি পরিণতি হতে পারে। জমি হারালেও নিজের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে পারে ইউক্রেন। নয়তো জমি এবং সার্বভৌমত্ব দুই-ই খোয়াতে পারে কিভ, যেমনটা চায় রাশিয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ কোন পথে শেষ হবে, আলাস্কা বৈঠকের পরে সেই ছবি আরও কিছুটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলি যে চাপ তৈরি করছিল, তা রুশ প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে ঝেড়ে ফেলেছেন। উল্টে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, রাশিয়ার ভৌগোলিক-রাজনৈতিক দাবিগুলি যত ক্ষণ না মানা হবে, তত ক্ষণ যুদ্ধ চলবে। বৈঠকের পরে পুতিন আগের মতোই জানিয়েছেন, টানাপড়েনের ‘মূল কারণ’ নির্মূল করতে হবে।
এই ‘মূল কারণ’ ঠিক কী, তা-ও বার বার স্পষ্ট করেছেন পুতিন। ইউক্রেনের পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’, উত্তর অতলান্তিক চুক্তি সংগঠনের পূর্ব ইউরোপে প্রভাব বিস্তার যে তিনি পছন্দ করছেন না, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন পুতিন। মনে করা হচ্ছে, এ ভাবে আসলে ইউক্রেন-সহ পূর্ব ইউরোপের উপরে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে রাশিয়া। এই উদ্দেশ্যেই ২০২২ সালে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করেছিল তারা। তবে সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও কিভ দখল করা হয়নি রাশিয়ার। ইউক্রেন সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পাশে পেয়েছে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি এবং আমেরিকাকে। তবে ইউক্রেন থেকে রুশ সৈন্যকেও পুরোপুরি বিদায় করতে পারেনি জ়েলেনস্কি প্রশাসন।
এই যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে?
জমির পরিবর্তে সুরক্ষা
ইউক্রেনের সরকারের একাংশ বুঝে গিয়েছে, রাশিয়ার দখল করা জমি ছিনিয়ে আনা চাপ। গত সপ্তাহে জ়েলেনস্কি ভিডিয়ো কলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতা এবং ট্রাম্পের সঙ্গে এই ভূখণ্ড নিয়ে বৈঠক করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিভ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, রাশিয়ার এই জমি দখলকে স্বীকৃতি তারা দেবে না। তা হলে পরবর্তীতে আরও জবরদখল করতে পারে রাশিয়া।
প্রসঙ্গত, ইউক্রেনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ এখন রাশিয়ার দখলে। প্রশ্ন উঠছে, বাকি চার ভাগ জমির কি হবে? ইউক্রেন চাইছে, ইউরোপের সহযোগী দেশগুলির সাহায্যে প্রতিরোধ গড়বে। দেশের বাকি চার ভাগ অংশ কোনও ভাবেই রাশিয়াকে দখল করতে দেবে না। ফ্রান্স, ব্রিটেন নিজেদের সেনা রাখতেও রাজি। তাদের আশা, আমেরিকাও পাশে থাকবে। যদিও আমেরিকা তা করতে চায় কি না, এখনও স্পষ্ট নয়।
পুতিন যদিও এ সব বরদাস্ত করতে আগ্রহী নন। ইউক্রেনের বাকি ৮০ শতাংশ জমিতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির (বেশির ভাগই ‘শত্রু’ বলে পরিচিত) কর্তৃত্ব তিনি মানতে চান না। তবে মন থেকে মানতে না চাইলে কী হবে, আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির চাপানো আর্থিক নিষেধাজ্ঞা নিয়েও চাপে রয়েছেন পুতিন। ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর প্রতিবেদন বলছে, পুতিনের আশঙ্কা, এই আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি বিপাকে পড়তে পারে। ট্রাম্প ইতিমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। পুতিন নিজের শাসনপাট হারানোরও আশঙ্কা করছেন বলে খবর। তা-ই এই পরিস্থিতিতে আর্থিক ধাক্কা সয়ে আর কত দিন পুতিন যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সমর্থ হতে পারে ইউক্রেন।
আরও পড়ুন:
অধীনতা
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হয়, তখন থেকে মস্কোর দাবি, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী আড়েবহরে ছোট করা হোক। পশ্চিমের দেশগুলি থেকে অস্ত্র সাহায্য নেওয়া কমিয়ে দিক কিভ। ইউক্রেনের সংবিধান, নেতৃত্ব, ভাষা, ইতিহাস, জাতীয় সত্ত্বা নিয়ে নীতি বদলের দাবিও করেছে রাশিয়া। রাশিয়ার এ সব দাবি মেনে নিলে তাদের ‘আক্রমণ’ যে ঠেকানো যাবে, তেমন নয় বলেই মনে করছেন কূটনীতিকেরা। ইউক্রেনের পূর্ব এবং দক্ষিণের অংশ বেহাত হতে পারে। তারা পাকাপাকি ভাবে রাশিয়ার ‘আশ্রিত’ দেশে পরিণত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের সার্বভৌমত্ব লাভের স্বপ্ন অধরাই থাকবে।
মনে করা হচ্ছে, এটাই চাইছে রাশিয়া। তারা ইউক্রেনের যুদ্ধ করার ক্ষমতা, ইচ্ছাটাই যুদ্ধ করে নির্মূল করতে চায়। এমনিতেই সাড়ে তিন বছর ধরে যুদ্ধ করে ইউক্রেনের সেনারা ক্লান্ত। ঊর্ধ্বতনদের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াশিংটনের এক বিশেষজ্ঞ সংস্থা কার্নেজি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সামরিক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান মনে করেন, ইউক্রেনের সেনা হয়তো ভেঙে পড়বে না। যুদ্ধক্ষেত্রে হেরে না গেলেও বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে। উল্টো দিকে, রাশিয়ার লোক এবং সেনার সংখ্যা ইউক্রেনের তুলনায় অনেক বেশি। সেটা তাদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কফম্যান ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-কে জানিয়েছেন, রাশিয়ার সুবিধা থাকলেও এই যুদ্ধ মোকাবিলার পথ খুঁজে নিয়েছে ইউক্রেন। ‘অভিযোজিত’ হয়েছে। লড়াই চালিয়ে গিয়েছে। ফলে রাশিয়ার কাছে আবার নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করা সহজ হবে না।