Advertisement
E-Paper

চিন, কানাডা, মেক্সিকোর পর ট্রাম্পের নিশানায় কি ভারতও? মোদীর ‘বন্ধুত্ব’ শুল্কচাপ ঠেকাতে পারবে?

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেই নয়াদিল্লির তরফে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কুটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিবিড় করার চেষ্টা চলছে। যাকে অনেকে বলছেন, ‘তুষ্ট করা চেষ্টা’।

Though India has reduced import tax on US products Donald Trump may not give relief to Narendra Modi in Tariff War

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৩০
Share
Save

গত ৭ নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পরেই তাঁর সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রবেশের পরে নয়াদিল্লির তরফে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিবিড় করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে পুরোদমে। যাকে অনেকে বলছেন, ‘তুষ্ট করার চেষ্টা’। কিন্তু সেই প্রচেষ্টায় ফল মিলবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সংশয় তৈরি হয়েছে সাউথ ব্লকে।

পড়শি মেক্সিকো, কানাডা এবং আমেরকার বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী চিনের বিরুদ্ধে নতুন শুল্কনীতি প্রয়োগের সিদ্ধান্তের পর পরবর্তী নিশানা কারা হবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনা তৈরি হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই তালিকায় রয়েছে ভারতের নামও। কারণ, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট যে দেশগুলির পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক বসিয়েছেন তাদের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে ওয়াশিংটনের। ঘটনাচক্রে, ভারতের ক্ষেত্রেও রয়েছে ঘাটতি। তবে মেক্সিকো ও কানাডার রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে এক মাসের জন্য বাড়তি শুল্ক স্থগিত করেছেন ট্রাম্প।

ঘাটতিতে ব্যতিক্রম আমেরিকাই

গত বছর কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক প্রকাশিত তথ্য জানাচ্ছে, যে ১০টি দেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আমদানি-রফতানি হয়েছে, গত অর্থবর্ষে (২০২৩-২৪) তাদের মধ্যে ন’টির সঙ্গেই বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে ভারতের। অর্থাৎ, ভারত থেকে রফতানির অঙ্কের তুলনায় সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পণ্য আমদানির অঙ্ক বেশি। প্রসঙ্গত, কোনও দেশে রফতানি বেশি করলে তা ‘বাণিজ্য উদ্বৃত্ত’ এবং আমদানি বেশি করলে তা ‘বাণিজ্য ঘাটতি’ বলে চিহ্নিত হয়।

অর্থমন্ত্রক প্রকাশিত বাণিজ্য ঘাটতির সেই তালিকায় সবচেয়ে উপরে রয়েছে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী চিন। এ ছাড়া রাশিয়া, ইরাক, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, হংকং, সিঙ্গাপুরও রয়েছে সেই তালিকায়। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী আমেরিকা। ওই রিপোর্ট জানাচ্ছে, নয়াদিল্লির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ওয়াশিংটনের ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৩৬৭৪ কোটি ডলার (প্রায় ৩ লক্ষ ২১ হাজার কোটি টাকা)। ভারতের রফতানির অঙ্ক প্রায় ৭৫৮০ কোটি ডলার। আমেরিকা থেকে আমদানি করা পণ্যের মূল্য প্রায় ৪০১০ কোটি ডলার।

হার্লেকে ছাড়, বিতাড়নে চুপ

গত ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ১৬০০ সিসি বা তার চেয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইকের উপর আমদানি শুল্ক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করার কথা ঘোষণা করেছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তে আমেরিকার বাইক নির্মাতা সংস্থা হার্লে ডেভিডসন সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। কারণ, ভারতে দামি বাইকের বাজারে এই সংস্থার প্রভাব অপ্রতিরোধ্য। পাশাপাশি, টেসলার মতো বিলাসবহুল মার্কিন গাড়ির উপরেও শুল্প কমেছে মোদী সরকারের এ বারের বাজেটে।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পরেই ট্রাম্প আমেরিকা থেকে অবৈধ অভিবাসীদের তাড়়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেই সেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন তিনি। আর প্রথম দফাতেই ‘কোপ’ পড়েছে ভারতীয় অভিবাসীদের উপর। বুধবারই আমেরিকা থেকে প্রথম দফায় ১০৪ জন অবৈধবাসী ভারতীয়কে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁদের নিয়ে বিমান নেমেছে পঞ্জাবের অমৃতসরে। এই অবৈধ অভিবাসীদের তালিকায় রয়েছেন ২৫ জন মহিলা এবং ১২ জন নাবালক। কনিষ্ঠতম অবৈধবাসী চার বছরের এক শিশু। তাঁরা কেউ পঞ্জাবের বাসিন্দা, কেউ গুজরাতের, কেউ আবার মহারাষ্ট্রের।

লক্ষণীয় ভাবে মোদী সরকারের বিদেশ মন্ত্রক ভারতীয় বিতাড়নের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করেনি। এই ‘মৌনব্রত’ আসলে ট্রাম্পকে তুষ্ট করার চেষ্টা কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রসঙ্গত, আমেরিকার অভিবাসন এবং শুল্ক দফতর ইতিমধ্যেই প্রায় ১৫ লক্ষ অবৈধ অভিবাসীর তালিকা তৈরি করে তাঁদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আর সেই ‘প্রথম দফার তালিকা’য় রয়েছেন ১৭ হাজার ৯৪০ জন ভারতীয় নাগরিক।

‘বন্ধু’ ট্রাম্পকে মোদীর বার্তা

গত ৭ নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের পরেই তাঁকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মোদী। সমাজমাধ্যমে সে কথা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘আমার বন্ধু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি দুর্দান্ত কথোপকথন হল। অসাধারণ জয়ের জন্য তাঁকে অভিনন্দন। প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, শক্তি, মহাকাশ এবং অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক আরও জোরদার করার জন্য আবার একসঙ্গে কাজ করতে উন্মুখ।’’

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় বার দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহ পরে গত ২৭ জানুয়ারি ট্রাম্প ফোন করেছিলেন মোদীকে। সেই কথোপকথনের কথা জানিয়ে এক্স পোস্টে মোদী লিখেছিলেন, ‘‘আমার প্রিয় বন্ধু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলে আনন্দিত হলাম। তাঁর ঐতিহাসিক দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য অভিনন্দন জানালাম। আমরা পারস্পরিক উন্নয়ন এবং বিশ্বস্ত অংশীদারির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আমাদের জনগণের কল্যাণে এবং বিশ্বের শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য একসঙ্গে কাজ করব।’’ কিন্তু লক্ষণীয় ভাবে সেই তালিকায় নেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রসঙ্গ।

ট্রাম্পের শুল্ক-হুঁশিয়ারি মোদীকে

গত নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট ভোটে জেতার পরেই কার্যত শুল্ক নিয়ে ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। মোদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সমীকরণ মসৃণ হলেও ক্যাপিটল হিলে বসে তিনি যে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিই অনুসরণ করবেন, সে কথা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রিপাবলিকান নেতা। জানিয়েছিলেন, তাঁর জমানায় ‘টিট ফর ট্যাট’ নীতিতেই গুরুত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ, যে দেশ আমেরিকার সঙ্গে যেমন সম্পর্ক রাখবে, সেই দেশের সঙ্গে তেমনই ব্যবহার করা হবে। সেই বিষয়ে ভারতের শুল্কনীতির সমালোচনাও করেন ট্রাম্প। বলেন, ‘‘যদি তারা (ভারত) আমাদের কর দিতে বলে, তবে আমরাও তাদের থেকে একই পরিমাণ কর নেব।’’

ভারতের বাজারে আমেরিকার বেশ কিছু পণ্যের জন্য ১০০ শতাংশ কর ধার্য রয়েছে। সেই প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলছিলেন, ‘‘পারস্পরিক শব্দটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত যদি আমাদের থেকে ১০০ শতাংশ কর নেয়, আমরা কি তাদের কাছ থেকে কিছুই নেব না? এটা ভাবা ভুল।’’ তাঁর জমানায় বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি যে আরও কড়াকড়ি হতে চলেছে এবং নয়াদিল্লিও তার ব্যতিক্রম নয়, তার স্পষ্ট আভাস ছিল ট্রাম্পের ওই মন্তব্যে।

বাণিজ্য-বিরোধের ইতিহাস

ঘটনাচক্রে, ট্রাম্পের আগের মেয়াদে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের শুল্ক-যুদ্ধ হয়েছিল। ২০১৯-এ ট্রাম্প সরকার ভারতীয় পণ্যকে আমেরিকার বাজারে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। সেই সঙ্গে ভারত থেকে কিছু ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের পণ্য, কাঠবাদাম, চানা, ছোলা, মুসুর ডালের উপরে আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল।

তার জবাবে ২৮টি পণ্য আমদানিতে বাধা তৈরির উদ্দেশ্যে চড়া শুল্ক বাড়িয়েছিল ভারত। আমেরিকা ভারতের কিছু পণ্য সে দেশে ঢোকার পথে বাধা তৈরি করায় পাল্টা জবাবে আমেরিকার ২৮টি পণ্যের উপরে চড়া শুল্ক বসানো হয়। এর মধ্যে আমেরিকা থেকে আসা আপেল, চানা, ডালের মতো ৮টি পণ্যে দু’বছর আগে চড়া শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

এ বারের বাজেটে বাকি ২০টি পণ্যে চড়া শুল্ক প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে ‘বরফ’ গলবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে শিল্প-বাণিজ্য মহলে। কারণ অতীতে ট্রাম্পের জমানায় একাধিক বার বাড়তি শুল্কের শিকার হয়েছে ভারতীয় পণ্য।

ভারত থেকে আমেরিকার রফতানি করা প্রথম পাঁচটি পণ্য হল মূল্যবান রত্ন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ওষুধ এবং মোম ও কয়লাজাত জ্বালানি। অন্য দিকে, আমেরিকা থেকে ভারত মূলত আমদানি করে জৈব জ্বালানি, ধাতব পদার্থ, পরমাণু চুল্লি ও জ্বালানি, বিমান ও বিমানের সর়ঞ্জাম। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ করলেও ট্রাম্প সরকারের কাছে ‘বিকল্প’ খোলা রয়েছে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তা নয়।

২০১৭ সালে ভারত রাশিয়া থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী এস-৪০০ ট্রায়াম্প কিনতে উদ্যোগী হলে ‘কাটসা’ আইন অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা জারির হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। পরিবর্তে মোদীকে আমেরিকা থেকে ‘টার্মিনাল হাই অলটিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ (থাড) এবং পেট্রিয়ট-৩ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা কেনার ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হুঁশিয়ারি উড়িয়ে মস্কোর সঙ্গে এস-৪০০ চুক্তি করেছিলেন মোদী। পরবর্তী সময়ে জো বাইডেনের আপত্তি খারিজ করে রাশিয়া থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও জ্বালানি তেল কেনার প্রক্রিয়া জারি রেখেছে ভারত। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মোদীর উপর আমেরিকার অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য ট্রাম্পের চাপ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

কী করতে পারে ভারত

বৃহৎ বাণিজ্যসঙ্গী আমেরিকার তরফে নিষেধাজ্ঞা চাপলে মোদী সরকারের আর্থিক বৃদ্ধি ও উন্নয়ন কর্মসূচি ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কূটনীতি ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, এই ধরনের একতরফা নিষেধাজ্ঞা এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিতর্কিত ব্যাপার। কিন্তু ভারতকে এ ব্যাপারে কৌশলী পদক্ষেপ করতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দ্বারস্থ হওয়ার পাশাপাশি, আমেরিকার সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালাতে পারে ভারত। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরকার মঙ্গলবার ট্রাম্পের ১০ শতাংশ শুল্কের জবাবে আমেরিকার পণ্যে ১০-১৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক বলবতের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। ‘বন্ধু’ ট্রাম্পের সঙ্গে কি শেষ পর্যন্ত এমন সংঘাতের পথে হাঁটবেন মোদী?

Trade War Tarrifs Import Tax Import Tarrif PM Narendra Modi Donald Trump US President Mexico China Canada India US-China Trade War US-India Trade Relations

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}