Advertisement
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
US Tariff

মেক্সিকো, কানাডাকে স্বস্তি দিলেন, আলোচনার বার্তা চিনের সঙ্গেও, শুল্ক নিয়ে কি সমঝোতার পথে ট্রাম্প

মেক্সিকো এবং কানাডার রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে আলোচনার পরে ওই দুই দেশের পণ্যের উপর আগামী এক মাস বাড়তি শুল্ক না নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু চিনের ক্ষেত্রে নীতি প্রত্যাহার হয়নি।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:৫৪
Share: Save:

মেক্সিকোর পর কানাডাকেও আপাতত নতুন শুল্কনীতি থেকে ছাড় দিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সোমবার মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেনবামের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনার পরে নরম হয়েছিলেন ট্রাম্প। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের বাসিন্দার আস্থা অর্জনে সফল হয়েছেন কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

ট্রাম্পের দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, মেক্সিকো এবং কানাডা থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত আপাতত ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকা। অন্য দিকে, ট্রাম্পের শুল্কনীতি আবার নতুন করে আমেরিকা এবং চিনকে সম্মুখ বাণিজ্য সমরের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমেরিকায় চিনা পণ্যের উপর ১০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর ‘ট্রাম্প কার্ড’ বিশ্ব বাণিজ্য মহলে নাড়া দিয়েছে।

চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও যে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন পাল্টা আমেরিকার পণ্যের উপর ১০-১৫ শতাংশ হারে শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করে। আমেরিকার পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের সম্পাদকীয়তে ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতিকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বোকা বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে। সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব যে আমেরিকার অর্থনীতিতে পড়বে, সে সম্পর্কে অবগত স্বয়ং ট্রাম্পও। সমাজমাধ্যমে পোস্টে আগেই তিনি লিখেছেন— ‘‘একটু কি কষ্ট হবে (প্রতিবেশীদের উপর শুল্ক চাপানোর ফলে)? হ্যাঁ, তা হয়তো হবে। কিন্তু আমরা আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলব। আর তার জন্য এইটুকু মূল্য দিতেই হবে।’’

ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণ

গত ২০ জানুয়ারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন দুই পড়শি দেশ, কানাডা এবং মেক্সিকোর পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন তিনি। এর পর গত শনিবার কানাডা, মেক্সিকো এবং চিনা পণ্যের উপর শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প। চিনা পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক এবং বাকি দুই দেশের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা করেন। মঙ্গলবার থেকেই তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।

কানাডার উপর ট্রাম্পের শুল্ক চাপানোর নেপথ্যে অন্যতম বড় কারণ ছিল ফেন্টানাইল। এই মাদকটি ব্যথার উপশমের ক্ষেত্রে মরফিনের তুলনায় বহু গুণ শক্তিশালী। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, কানাডা হয়ে এই মাদক আমেরিকায় প্রবেশ করছে। ট্রুডো যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, আমেরিকায় যত ফেন্টানাইল রয়েছে, তার মাত্র এক শতাংশই কানাডা থেকে গিয়েছে। সোমবার ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর ফোনালাপেও উঠে এসেছে ফেন্টানাইলের প্রসঙ্গ। ট্রুডো সোমবার ট্রাম্পকে আশ্বস্ত করেছেন, ফেন্টানাইল আমেরিকায় প্রবেশ করা রুখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে কানাডা। সীমান্তে নজরদারিও আরও বৃদ্ধি করা হবে বলে জানিয়েছেন ট্রুডো।

এর পরেই এখনই শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসেন ট্রাম্প। সংগঠিত অপরাধ রুখতে কানাডা এবং আমেরিকা একটি যৌথবাহিনী ‘জয়েন্ট স্ট্রাইক ফোর্স’ গঠনের বিষয়েও সহমত হয়েছে। ট্রাম্প জানান, কানাডা থেকে আমেরিকায় ফেন্টানাইল প্রবেশ রুখতে ওয়াশিংটনের তরফেও প্রয়োজনীয় আর্থিক লগ্নি করা হচ্ছে। ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমেরিকার তরফেও ২০ কোটি ডলার খরচের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমাজমাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, “এতে সবার জন্যই ভাল হল।’’ কার্যত একই অভিযোগ ছিল মেক্সিকোর বিরুদ্ধেও। ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘‘চিনে তৈরি বহু অবৈধ ওষুধ মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে আমেরিকায় ঢুকলেও বেজিং কোনও পদক্ষেপ করেনি। চিন যত দিন না এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে, তত দিন পর্যন্ত চিনা পণ্যে শুল্ক চাপানো হবে।’’ অভিযোগের প্রেক্ষিতে সীমান্তে অবৈধ অভিবাসন এবং চোরাচালান রুখতে বাড়তি ১০ হাজার সেনা মোতায়েনের জন্য ট্রাম্পকে আশ্বাস দিয়েছিলেন ক্লডিয়া। তার পরেই ‘বরফ’ গলেছে।

জিনপিংয়ের প্রত্যাঘাত, ট্রাম্পের ‘বার্তা’

ট্রাম্পের নয়া শুল্কনীতির জবাবে আমেরিকার পণ্যের উপরেও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে চলেছে চিন! আমেরিকা থেকে আসা কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর ১৫ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেল, কৃষি সরঞ্জাম ও বড় গাড়ির উপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে বলে মঙ্গলবার বার্তা দিয়েছে বেজিং। পাশাপাশি গুগ্‌লের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ এনেছে জিনপিংয়ের প্রশাসন। এই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করবে বেজিং।

তবে গুগ্‌ল চিনে সাধারণ ভাবে নিষিদ্ধ। অংশীদারির ভিত্তিতে কিছু সংস্থার সঙ্গে কাজ করে তারা। চিনের তরফে মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, আমেরিকার একতরফা শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মের পরিপন্থী। এটি চিন ও আমেরিকার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সম্পর্ককেও বিঘ্নিত করে। সে কারণেই আমেরিকাকে শিক্ষা দিতে পাল্টা শুল্ক আরোপের পথে হাঁটছে চিন। অন্য দিকে, হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আলোচনা হতে পারে ট্রাম্প-জিনপিংয়ের। আসন্ন ‘বাণিজ্য-যুদ্ধ’-এর আবহে এই প্রথম এত গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক আলোচনা হতে চলেছে দুই দেশের।

রাষ্ট্রপুঞ্জে চিনের প্রতিনিধি ফু কং জানিয়েছেন, আসন্ন নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকেও সাক্ষাৎ হতে পারে চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই এবং আমেরিকার বিদেশসচিব মার্কো রুবিও-র। সেখানেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হতে পারে দু’দেশের প্রতিনিধির। এর আগে ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে চিনা পণ্যে আরোপিত শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের তরফে বেজিংয়ের উদ্দেশে ‘আলোচনার বার্তা’ আসলে সমঝোতার ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে।

অতীতেও এমন করেছেন ট্রাম্প

আমেরিকা এবং চিনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ নতুন নয়। ২০১৮ সালে এই যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা করেছিল আমেরিকাই। ঘটনাচক্রে, সে সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ট্রাম্পই। তিনি প্রথমে চিন থেকে আমদানি করা সৌর প্যানেল এবং ওয়াশিং মেশিনের উপর ২০-৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করেন। তার পর ধাপে ধাপে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের উপরেও অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাম্প প্রশাসন। পাল্টা ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পথে হাঁটে জিনপিং সরকারও।

২০২০ সালে দুই দেশই নিজেদের মধ্যে চুক্তি সই করে বাণিজ্য যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেয়। কেউ আর নতুন করে অতিরিক্ত শুল্ক চাপাবে না, এমন কথা হয়। কিন্তু বহাল থাকে দু’দেশের আরোপ করা শুল্ক। প্রভাব পড়েছিল দু’দেশেরই আমদানি-রফতানির উপর। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে আমেরিকায় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার চিনা পণ্য আমদানি হয়েছে। আমেরিকা থেকে চিনে রফতানি হয়েছে মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকার পণ্য। ২০১৯ সালে দু’দেশের মধ্যেই আমদানি এবং রফতানির পরিমাণ কমেছিল। সে বছর চিনে আমেরিকার পণ্য রফতানি হয় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার। প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার চিনা পণ্য আমদানি হয় আমেরিকায়।

২০২২ সালেও দু’দেশের মধ্যে আমদানি এবং রফতানির পরিমাণ প্রায় একই ছিল। ২০২৩ সালে চিনে আমেরিকার পণ্য রফতানি অনেকটাই কমে যায়। সে বছর চিনে ৪২ হাজার কোটি টাকার আমেরিকার পণ্য পাঠানো হয়। আর চিন থেকে আমেরিকায় আমদানি করা হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য। ২০২৪ সালে এই পরিসংখ্যান ছিল যথাক্রমে প্রায় ৪০ হাজার কোটি এবং প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। অতীতে অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর ফলে যেমন আমদানি, রফতানিতে প্রভাব পড়েছে, তেমন দু’দেশের মুদ্রাস্ফীতিও প্রভাবিত হয়। তাই নতুন করে দু’দেশের পরস্পরের উপর শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

২০২০ সালে চিনে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমেরিকা থেকে রফতানি হয়। আমেরিকা আমদানি করে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকার চিনা পণ্য। ২০২১ সালে সেই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে প্রায় ১৫ হাজার কোটি এবং সাড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা। মেক্সিকো এবং কানাডার উপর ৩০ দিনের জন্য অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর বিষয় থেকে সরে এসেছেন। তবে চিনা পণ্যের উপর ধার্য শুল্ক নিয়ে আগের অবস্থানেই অটল থেকেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তার পর চিনও ঘোষণা করেছে, পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে তারা আমেরিকা থেকে আসা কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর ১৫ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেল, কৃষি সরঞ্জাম ও বড় গাড়ির উপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Donald Trump European union
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy