Advertisement
E-Paper

তুরস্কে বিফল অভ্যুত্থান, ধুন্ধুমার লড়াইয়ে হত ২৬৫, আহত প্রায় দেড় হাজার

রাত তখন মোটে সাড়ে দশটা। হঠাৎই রাজধানী আঙ্কারা-সহ দেশের বিভিন্ন শহরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেতু, সরকারি ভবনে ঢুকে পড়ল উর্দি পরা সেনা। তাদের বাধা দিতে হাতে অস্ত্র তুলে নিল আরও এক দল সেনা, সঙ্গে পুলিশ। চলল গুলি-পাল্টা গুলি।

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩০
একটু সাহায্যের আর্তি। বিদ্রোহীদের গুলিতে রক্তাক্ত আমজনতা। ইস্তানবুলের তাকসিম স্কোয়ারে। ছবি: এএফপি।

একটু সাহায্যের আর্তি। বিদ্রোহীদের গুলিতে রক্তাক্ত আমজনতা। ইস্তানবুলের তাকসিম স্কোয়ারে। ছবি: এএফপি।

রাত তখন মোটে সাড়ে দশটা। হঠাৎই রাজধানী আঙ্কারা-সহ দেশের বিভিন্ন শহরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেতু, সরকারি ভবনে ঢুকে পড়ল উর্দি পরা সেনা। তাদের বাধা দিতে হাতে অস্ত্র তুলে নিল আরও এক দল সেনা, সঙ্গে পুলিশ। চলল গুলি-পাল্টা গুলি। তার মধ্যেই দেশের সরকারি সংবাদমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম জানিয়ে দিলেন, বিদ্রোহ করেছে সেনার একাংশ। বিদ্রোহী সেনারাও পাল্টা বিবৃতিতে জানিয়ে দিল, দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা করতেই তাদের এই পদক্ষেপ। এক সময়ে ইস্তানবুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরও চলে গিয়েছিল বিদ্রোহীদের হাতে। যদিও সেনাবাহিনীর বড় অংশ এবং জনতার সক্রিয় বিরোধিতায় বিদ্রোহ স্থায়ী হল না বেশিক্ষণ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করল বিদ্রোহীরা। মৃত্যুও হল অনেকের। গদিচ্যুত হওয়ার মুখ থেকে বেঁচে গেলেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোগান।

বিদ্রোহে অন্তত ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত দেড় হাজারের কাছাকাছি। দুই শীর্ষ সেনা কর্তা আদেম হুদুতি ও অভনি আনগুন-সহ প্রায় হাজার পাঁচেক বিদ্রোহী সেনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

কামাল আতাতুর্কের দেশে সেনার এমন বিদ্রোহে বিপদের আঁচ পাচ্ছেন অনেকেই। বিশেষত পশ্চিমী দুনিয়া। দেশের দক্ষিণে ইরাক এবং সিরিয়ার মতো আইএস-জঙ্গিঘাঁটির বিপদ ঘাড়ে নিয়ে থাকা তুরস্ক বহু দিন ধরেই মার্কিন মিত্র। সিরিয়ায় আমেরিকার আইএস-বিরোধী যুদ্ধেও অংশ নিয়েছে তারা। কারণ তাদের নিজের দেশেও ছায়া পড়ছে আইএসের। ইরাক, সিরিয়া থেকে আইএস জঙ্গিরা ঢুকে মাঝেমধ্যেই হামলা চালাচ্ছে। দেশের অন্দরেই চলছে কুর্দ বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই। সঙ্গে বিপদ ক্রমবর্ধমান মৌলবাদ। যার পিছনে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ভূমিকা দেখছেন অনেকেই।

এরদোগানের সরকার এই অভ্যুত্থানের জন্য যাঁকে দায়ী করেছে, সেই ধর্মগুরু ফেতুল্লাহ গুলেন আবার আমেরিকাতেই আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক বছর আগে। যা নিয়ে এ দিন ওয়াশিংটনকে বিঁধেছেন প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। তাঁর কথায়, ‘‘যে দেশ ওই ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছে, তারা তুরস্কের সঙ্গে শত্রুতা

করছে।’’ বিদ্রোহীদের ‘শিক্ষা’ দিতে দেশে মৃত্যুদণ্ড ফেরানোর কথাও ভাবছে সরকার।

কিন্তু তাতেও আগামী দিনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এমন প্রশ্ন ওঠার কারণও আছে। ধর্মগুরু গুলেনের সঙ্গে এক সময়ে তুর্কি প্রেসিডেন্টের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরে রাজনৈতিক বিবাদের জেরে আমেরিকায় আশ্রয় নেন ফেতুল্লাহ গুলেন। ফেতুল্লাহ ও তাঁর অনুগামীরা এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত থাকার সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তুর্কি রাজনীতিক ও সরকারি কর্তাদের একটা বড় অংশও মনে করেন, বিচারব্যবস্থায় ফেতুল্লাহের অনুগামীর সংখ্যা অনেক। এ দিনই দেশের শীর্ষ আদালতের বিচারপতি এবং ফেতুল্লাহ-ঘনিষ্ঠ আলপার্সলান অলতানকে আটক করেছে সরকার। কিন্তু সেনায় ফেতুল্লাহের তেমন প্রভাব আছে বলে মনে করেন না প্রশাসনের শীর্ষ-কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, আতাতুর্কের আমল থেকেই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর প্রহরী হিসেবে পরিচিত তুর্কি সেনা। মুসলিম মৌলবাদের বাড়াবাড়ি দেখলে কয়েক বার অভ্যুত্থান করে ক্ষমতাও হাতে নিয়েছে তারা। এ বারেও এরদোগানের মৌলবাদ-ঘনিষ্ঠতা ঠেকাতেই সেনার একাংশ এ ভাবে হাতে অস্ত্র নিয়ে পথে নেমেছিল।

মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, সিরিয়ায় আইএস-বিরোধী লড়াইয়ে অস্ত্র সরবরাহ করতে গিয়ে ইসলামি মৌলবাদী জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছে তুর্কির গুপ্তচর সংস্থা। ১৯৮০-র দশকে আফগানিস্তানে রুশ-বিরোধী জেহাদের সময়ে পাকিস্তানের মাধ্যমে মুসলিম মৌলবাদীদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিল সোভিতে-বিরোধী দেশগুলি। পাকিস্তান সেই সুযোগে মৌলবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। এরদোগানের সরকারও সেই পথে হাঁটছে বলে ধারণা বারাক ওবামা প্রশাসনের একাংশের। তাই সেনার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ অংশটি এই বিদ্রোহে যুক্ত থাকতে পারে বলে ধারণা অনেকের।

প্রথমে বেশ কয়েক ঘণ্টা এর়দোগানের সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে নাটকীয় ভাবে অজ্ঞাত স্থান থেকে নিজের ফোনের ফেসটাইম অ্যাপের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা দেন তিনি। দাবি করেন, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের রিসর্ট শহর মারমারিসে তাঁর উপরেও হামলার চেষ্টা করেছিল বিদ্রোহীরা।

প্রেসিডেন্টের বক্তৃতার পরেই আঙ্কারা-ইস্তানবুলের রাস্তায় নেমে পড়েন আমজনতার বড় অং‌শ। বিদ্রোহী সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তাঁরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রেই ট্যাঙ্ক থেকে সেনাদের টেনে নামিয়েছেন নিরস্ত্র মানুষ। কিছু ক্ষণেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই বিদ্রোহের পিছনে সাধারণ মানুষের তেমন সমর্থন নেই। সেনার বড় অং‌শও এখনও প্রেসিডেন্টের পাশেই রয়েছে।

শনিবার ভোরের মধ্যে একে একে বসফরাস প্রণালীর উপরের সেতু, ইস্তানবুলের তাকসিম স্কোয়ার-সহ বিভিন্ন এলাকায় আত্মসমর্পণ শুরু করে বিদ্রোহীরা। তার আগেই বিদ্রোহীদের হাতে আটক সেনাপ্রধান জেনারেল হুলুসি আকারকে উদ্ধার করেছে এরদোগান অনুগত সেনারা। তবে তাঁর সঙ্গে আটক হওয়া বাকি শীর্ষ সেনাকর্তাদের কোনও খবর পাওয়া যায়নি।

শনিবার ভোররাতে ইস্তানবুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে নামে এরদোগানের বিমান। তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন কাতারে কাতারে মানুষ। প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘দেশে বিদ্রোহ আর বিশ্বাসঘাতকতার আগুন ছড়ানো হয়েছে। বিদ্রোহীদের এর ফল ভুগতে হবে।’’

তুর্কি গোয়েন্দারা প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছেন, ‘‘শান্তি কাউন্সিল’’ নামে পরিচিত বিদ্রোহী সংগঠনের নেতা ছিলেন কর্নেল মুহারম কোসে নামে এক অফিসার। তিনি এরদোগান সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। তবে আরও কোনও বড় শক্তি এর পিছনে আছে কিনা তা খুঁজে দেখছেন গোয়েন্দারা। তুর্কি সেনার উর্দি পরা আট জনকে নিয়ে গ্রিসে নেমেছে একটি হেলিকপ্টার। সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে ওই আট জন। ওই আট জনকে ফেরত পাঠাতে গ্রিসকে অনুরোধ করেছে তুরস্ক। গোয়েন্দাদের আশা, পলাতকদের কাছ থেকেও নতুন সূত্র পাওয়া গিয়েছে।

সিরিয়া-ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যতম অংশীদার তুরস্ক। সম্প্রতি ইস্তানবুলে বড় ধরনের হামলাও চালিয়েছে আইএস। আবার সিরিয়া সীমান্তের কুর্দ বিদ্রোহীদের সঙ্গেও লড়াই চলছে এরডোগান সরকারের। সেই সময়ে ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থল দেশটিতে এমন অভ্যুত্থানের চেষ্টায় চিন্তিত পশ্চিমী দুনিয়া। এরদোগানের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এমনকী আঞ্চলিক রাজনীতির দুই মেরুতে থাকা ইজরায়েল ও ইরানও এই অভ্যুত্থানের বিরোধিতায় এক সুর।

এরদোগানপন্থীদের দাবি, তুর্কি গণতন্ত্রে এক কালো ছাপ পড়ল। কিন্তু রাস্তায় নেমে গণতন্ত্রকে রক্ষা করলেন তুরস্কের মানুষ।

Turkey military coup killed
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy