Advertisement
E-Paper

অবসাদেই কি সব শেষ করে দিলেন জাহারি

ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর সুখ ছিল না। ৮ মার্চ যখন বিমানের ককপিটে গিয়ে বসেছিলেন কম্যান্ডার পাইলট জাহারি আহমেদ শাহ, তার এক দিন আগেই তাঁর স্ত্রী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এ কথা জানান, জাহারিরই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৪ ০১:৫৯
জাহারি আহমেদ শাহ

জাহারি আহমেদ শাহ

ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর সুখ ছিল না।

৮ মার্চ যখন বিমানের ককপিটে গিয়ে বসেছিলেন কম্যান্ডার পাইলট জাহারি আহমেদ শাহ, তার এক দিন আগেই তাঁর স্ত্রী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এ কথা জানান, জাহারিরই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

অন্য এক মহিলার সঙ্গে জাহারির সম্পর্ককে কেন্দ্র করে স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য চলছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। তবু তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি জাহারি। বন্ধুটি জানাচ্ছেন, মানসিক ভাবে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। বিপর্যস্ত মন নিয়েই বিমান নিয়ে উড়ে যান আকাশে।

এমএইচ ৩৭০ হারিয়ে যাওয়ার পরে তদন্তের গতিপ্রকৃতি এখন আবর্তিত হচ্ছে মূলত জাহারিকে ঘিরেই। কখনও শোনা যাচ্ছে, তাঁর রাজনৈতিক গুরু সম্প্রতি জেলবন্দি হওয়ায় তিনি অবসাদে ভুগছিলেন। কখনও জানা গিয়েছে, বাড়িতে ককপিটের মতো যন্ত্রপাতি বসিয়ে বিমান-চালনা অনুশীলন করতেন। সেখান থেকে সম্প্রতি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নাকি উড়িয়ে দিয়েছিলেন!

কিন্তু এ সবের চেয়েও তদন্তে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে জাহারির দাম্পত্য সমস্যা। জানা গিয়েছে, ককপিটে বসার কিছু আগে এক মহিলা তাঁকে ফোন করেছিলেন। কে সেই মহিলা? স্ত্রী নাকি বান্ধবী? কী কথা হয়েছিল দু’জনের? এই সব প্রশ্ন নিয়ে ধোঁয়াশার পাশাপাশি সন্দেহ ছড়াচ্ছে জাহারির মানসিক সুস্থতা নিয়ে। জাহারির বন্ধুই বলছেন, মনের দিক থেকে জাহারি সুস্থ ছিলেন না। নইলে কেন তিনি আকাশে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন বিশ্বের সঙ্গে? আত্মহননের উদ্দেশ্যেই কি?

জানা গিয়েছে, সে দিন রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরে বিমানটি নিয়ে পাইলট ৪৩ হাজার ফুটেরও উপরে উঠে গিয়েছিলেন। ৪৫ হাজার ফুট উচ্চতায় বিমানটি ২৩ মিনিট একটানা উড়েছিল। বিশেষজ্ঞদের কথায়, বোয়িং ৭৭৭-২০০ বিমান সাধারণ ভাবে সর্বোচ্চ ৪১ হাজার ফুটে ওড়ে। জাহারি হঠাৎ তার চেয়েও বেশি উঁচুতে গেলেন কেন? কো-পাইলটই বা তাতে রাজি হলেন কেন? কলকাতায় এয়ারলাইন্স অপারেটিং কমিটির চেয়ারম্যান, পাইলট ক্যাপ্টেন সর্বেশ গুপ্ত-র কথায়, “কম্যান্ডারের যদি দুরভিসন্ধি থাকে, তাহলে সে কো-পাইলটকে ঘায়েল করে ওই কাজ করে থাকতে পারেন। অথবা কো-পাইলট ককপিটের বাইরে শৌচাগারে যাওয়ার পরে ককপিটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিতে পারেন।”

কিন্তু বাকি যাত্রীরা কী করছিলেন? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ৪১ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় ককপিট থেকে কেউ যদি যাত্রী-কেবিনের বায়ুচাপ কমিয়ে দেন, তাহলে কয়েক মিনিটের মধ্যে যাত্রীদের শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। এই অবস্থায় অক্সিজেন মাস্ক নেমে আসবে যাত্রীদের সামনে। কিন্তু তা দিয়ে বড়জোর ১২ মিনিট স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চালানো সম্ভব। তার পরেই নেতিয়ে পড়বেন তাঁরা। একটা সন্দেহ তাই দানা বাঁধছে, যাত্রীদের অচেতন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই কি তবে অত উঁচুতে উঠেছিলেন জাহারি?

কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন এও থাকে যে, আত্মহত্যা তো চাইলে বাড়িতে বসেই করতে পারতেন! এতগুলো মানুষের জীবন নষ্ট করবেন কেন জাহারি? স্পষ্ট উত্তর নেই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে একটা দাবি উঠতে শুরু করেছে। সেটা হল, যাঁর হাতে শতাধিক মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করে, সেই পাইলট মানসিক ভাবে স্থিতিশীল রয়েছেন কি না, তা নিশ্চিত করা হবে না কেন? কোনও হদিশ পাওয়া কি সম্ভব নয়?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বলেছেন, অবসাদ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়, তখন একটা মানুষ নিজের জীবনের পরোয়া করে না। পরোয়া করে না অন্য মানুষের জীবনও। কিন্তু সে রকম অবসাদ বেশি দিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বাইরে থেকে দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু কেউ যদি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে কোনও অনিষ্ট করতে চায়? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, সেটা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। প্রতিটি উড়ানের আগেও যদি ‘সাইকোমেট্রি’ পরীক্ষা করা হয়, তা হলেও জানা যাবে না যে পাইলটের মনে কোনও দুরভিসন্ধি রয়েছে কি না।

ভারতের বিমান পরিবহণের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ)-এর এক কর্তা বলছেন, পাইলট যাতে মানসিক ভাবে ক্লান্ত না হয়ে পড়েন, সেটা দেখার জন্য ভারতে এক জন পাইলটকে মাসে সর্বোচ্চ ১২০ ঘন্টার বেশি উড়তে দেওয়া হয় না। বেশির ভাগ সংস্থাই চেষ্টা করে মাসে ১০০ ঘন্টার বেশি ডিউটি না দিতে।

ভারতে প্রতিটি উড়ানের আগে পাইলটদের ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। তাতে দেখা হয়, শেষ ১২ ঘণ্টায় সেই পাইলট মদ্যপান করেছিলেন কি না। এ ছাড়া সব দেশেই বছরে এক বার করে পাইলটদের শারীরিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। তাতে রক্ত পরীক্ষা, রক্তচাপ, দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করা হয়। মাপকাঠির হেরফের হলে পাইলটকে উড়তে দেওয়া হয় না। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এক পাইলট জানাচ্ছেন, শারীরিক পরীক্ষার সময়ে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রশ্নও করা হয়। দু’বছরে এক বার মেডিক্যাল বোর্ড তাঁদের থেকে জানতে চায় “পারিবারিক অবস্থা কেমন? অন্য সমস্যা রয়েছে কি না ইত্যাদি।”

ভারত-সহ অনেক দেশে এমন ব্যবস্থা নেই। পাইলটদের ডাক্তারি পরীক্ষায় মনোবিদরা উপস্থিত থাকেন না। তবে তাতে বিরাট কিছু এসে যায় বলে মনে করেন না পাইলটদের বড় অংশই। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ওই পাইলটই বলছেন, “মনোবিদের প্রশ্নের উত্তরে সত্যি বলব কি না, সে তো আমার উপরেই নির্ভর করছে।” সুতরাং পাইলটের মনের কাছে যাত্রী-ভাগ্য শেষ পর্যন্ত অসহায়!

malaysian airline mh 370 johari
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy