Advertisement
E-Paper

রেডার এড়িয়ে বিমান কি তালিবান ডেরায়

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের নিখোঁজ বিমান এমএইচ ৩৭০ যে চক্রান্তের কবলে পড়েছে, সেটা শনিবারই ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। রেডারের নাগাল এড়ানোর জন্য ইচ্ছে করেই বিমানটিকে নিচু দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কি না এবং কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেটিকে নামানো হয়েছে কি না, সেটাই এখন ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। এবং সে ক্ষেত্রে পাক-আফগান সীমান্তের তালিবান অধ্যুষিত অঞ্চলটি গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে, এমন সন্দেহও জোরদার হচ্ছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩৪
নিখোঁজ যাত্রীদের জন্য প্রার্থনা। সোমবার কম্বোডিয়ায়। ছবি: রয়টার্স।

নিখোঁজ যাত্রীদের জন্য প্রার্থনা। সোমবার কম্বোডিয়ায়। ছবি: রয়টার্স।

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের নিখোঁজ বিমান এমএইচ ৩৭০ যে চক্রান্তের কবলে পড়েছে, সেটা শনিবারই ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। রেডারের নাগাল এড়ানোর জন্য ইচ্ছে করেই বিমানটিকে নিচু দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কি না এবং কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেটিকে নামানো হয়েছে কি না, সেটাই এখন ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। এবং সে ক্ষেত্রে পাক-আফগান সীমান্তের তালিবান অধ্যুষিত অঞ্চলটি গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে, এমন সন্দেহও জোরদার হচ্ছে।

শনিবারই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রেজাক জানিয়ে দিয়েছিলেন, চক্রান্ত করেই বিমানটির পথ পরিবর্তন করা হয়েছে। তার পর রবিবার সন্ধেবেলায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে ফোন করেছিলেন রেজাক। বিমান-রহস্যের তদন্তে ভারতের সাহায্য চান তিনি। ফোন করেন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেও। তার পরেই ভারতীয় বিমানবন্দরগুলির রেডারে কোনও সঙ্কেত ধরা পড়েছিল কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। বিমানবন্দর সূত্রের খবর কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লি বা মুম্বই, কোনও রেডারেই সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।

কিন্তু তদন্তকারীদের একাংশের আশঙ্কা, গন্তব্য হিসেবে পাক-আফগানিস্তান সীমান্তের বিস্তীর্ণ তালিবান-অধ্যুষিত অঞ্চলটি বেছে নিয়ে থাকতে পারে বিমানের ষড়যন্ত্রীরা। সে ক্ষেত্রে ভারতের আকাশপথ এড়িয়ে যাওয়ার উপায় কার্যত নেই। তা হলে কী কী পন্থায় ভারতের নজর এড়িয়ে বিমানটি গিয়ে থাকতে পারে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পাক-আফগান সীমান্তবর্তী ওই এলাকা কেন বিমানটির গন্তব্য হতে পারে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তদন্তকারীরা বলছেন, কোনও প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকা ছাড়া বোয়িং ৭৭৭-এর মতো বিশাল একটি বিমানকে দশ দিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা সম্ভব নয়। সে দিকে থেকে তালিবান অধ্যুষিত ওই অঞ্চলটি একেবারে আদর্শ। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ ওখানে নেই বললেই চলে। ফলে সরকারি নজরদারি এবং রেডার-জালকে এড়ানো অপেক্ষাকৃত সহজ। মার্কিন সামরিক নজরদারি অবশ্য রয়েছে। কিন্তু তাদের চোখেও ধুলো দেওয়া গিয়েছে, নাকি সামগ্রিক ভাবে সামরিক নজরদারিতেও বড়সড় ফাঁক থেকে গিয়েছে, সেটা তদন্তের পরেই জানা যাবে। আপাতত ওই স্পর্শকাতর পার্বত্য এলাকায় তল্লাশি চালানোর জন্য কূটনৈতিক অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা চলছে।

তবে ওই এলাকাটিকেই বিমানের একমাত্র গন্তব্য ধরে না নিয়ে, অন্যান্য সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। তারই অঙ্গ হিসেবে এই মুহূর্তে উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত জল-স্থল-আকাশ সর্বত্র অনুসন্ধান চালাচ্ছে মোট ২৫টি দেশ। তল্লাশির মানচিত্র উত্তর এবং দক্ষিণ করিডরে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। উত্তরে পাকিস্তান-সহ উজবেকিস্তান বা কিরঘিজস্তানের মতো দেশও এ দিন তল্লাশিতে নেমেছে। যে সব বিমানবন্দর খুবই কম ব্যবহার করা হয় কিন্তু লম্বা রানওয়ে আছে, খোঁজ চলছে সেখানে। দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়া-তাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম-চিনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, মায়ানমার, কাম্বোডিয়া। আমেরিকা, চিন এবং ফ্রান্সের কাছে উপগ্রহ সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হচ্ছে।

তদন্তকারীরা মোটামুটি নিশ্চিত ৮ মার্চ রাত ১টা ১৯ মিনিটে শেষ যে রেডিও-বার্তা এসেছিল ‘শুভরাত্রি’ জানিয়ে, সেটা এমএইচ ৩৭০-এর কো-পাইলটেরই গলা। সেই কো-পাইলট ও পাইলটের অতীত ঘেঁটে দেখছেন গোয়েন্দারা। কিন্তু রেডিও-বার্তা আসার আগেই বিমানের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্য একটি ডিজিটাল মাধ্যম (এয়ারক্রাফ্ট কমিউনিকেশনস অ্যাড্রেসিং অ্যান্ড রিপোর্টিং সিস্টেম বা অকার্স) নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছিল না হয়নি, সেটা নিয়ে নতুন করে ধন্দ তৈরি হয়েছে। রবিবার মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছিল। সোমবার মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের শীর্ষ কর্তা বললেন, তেমন কোনও প্রমাণ নেই।

পরপর সব ক’টি সঙ্কেত মিলিয়ে দেখলে ছবিটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম ৩০ মিনিট অন্তর বার্তা আসার কথা বিমানের অকার্স থেকে। ৮ মার্চ রাত ১টা ৭ মিনিটে ওই বার্তা এসেছিল। পরের বার্তা আসার কথা ছিল ১টা ৩৭ মিনিটে। সেটা আসেনি। একটি মত বলছে, ব্যবস্থাটি নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছিল। অন্য মত বলছে, সেটা স্পষ্ট বলা যাচ্ছে না। অন্য কোনও গণ্ডগোলও হয়ে থাকতে পারে।

রাত ১টা ৭ মিনিটে অকার্স-বার্তা আসার পরে ১টা ১৯ মিনিটে রেডিও-বার্তা পায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বা এটিসি। কো-পাইলটের গলা ভেসে আসে, “অল রাইট, গুড নাইট!” এটিসি-র সঙ্গে সেটাই শেষ কথা। এর ঠিক দু’মিনিট পরে ১টা ২১ মিনিটে অসামরিক-বাণিজ্যিক রেডারে শেষ বার ধরা পড়ে বিমানটি। ২টো ১৫ মিনিটে বিমানটির সঙ্কেত ধরা পড়ে সামরিক রেডারে। তদন্তে প্রকাশ, তত ক্ষণে বিমানটি তার নির্দিষ্ট পথ থেকে বেঁকে গিয়েছে। উপগ্রহে বিমানটির শেষ সঙ্কেত মিলেছে ৯ মার্চ সকাল ৮টা ১১ মিনিটে। কিন্তু সেই অবস্থানটি ঠিক কোথায়, তা এখনও বের করা যায়নি। জল-স্থল-আকাশ, যে কোনও জায়গা থেকেই ওই সঙ্কেত এসে থাকতে পারে।

অকার্স এবং এটিসি-র সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি ইচ্ছে করে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়াও হয়, সে ক্ষেত্রে সামরিক-অসামরিক রেডার থেকে কী করে নিজেকে লুকোল বিমানটি? বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, বাণিজ্যিক রেডারে ধরা দেবেন না বলে বিমানের ট্রান্সপন্ডারটিও (যে যন্ত্রের মাধ্যমে রেডারে ধরা পড়ে তার গতিবিধি) সম্ভবত ‘অফ’ করে রেখেছিলেন পাইলট। ‘অফ’ করা থাকতে পারে উপগ্রহ মারফত যোগাযোগের ব্যবস্থা ‘স্যাট-কম’ও। ভারতের এক এটিসি বিশেষজ্ঞ-র কথায়, “সে ক্ষেত্রে কলকাতা বা চেন্নাইকে জানতে না দিয়েই বিমানটি উড়ে গিয়ে থাকতে পারে ভারতের আকাশ দিয়ে। হয়তো বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়েই।”

এখানেও প্রশ্ন রয়েছে। যাত্রিবিমানগুলি সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ে যায়। ভারতের আকাশে নিয়মিত উড়ে বেড়ানো পাইলট, ক্যাপ্টেন জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, একটি বিমান তার ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে এটিসি-র পরামর্শ ছাড়া যদি ওই উচ্চতায় ওড়ে, তার ফল মারাত্মক হতে পারে। কারণ কাছাকাছি কোন বিমান চলে আসছে, তা পাইলট বুঝতে পারবেন না।

এখানেই প্রবল হচ্ছে, নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার তত্ত্ব। বিশেষজ্ঞদের একাংশের সন্দেহ, মাটি থেকে ৫ হাজার ফুট উপর দিয়েও উড়ে গিয়ে থাকতে পারে ওই বিমান। সে ক্ষেত্রে আকাশে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ, ওই উচ্চতায় অন্য কোনও বিমান ওড়ে না। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রধান চারটি বিমানবন্দরে (কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লি, মুম্বই) প্রাইমারি রেডার বসানো রয়েছে। ট্রান্সপন্ডার অফ করে রাখলেও তাতে ধরা পড়ে যায় বিমানের গতিবিধি। কিন্তু ৫ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে গেলে এবং প্রাইমারি রেডার থেকে ৪০ মাইল দূরত্ব বজায় রাখলে সেই বিমানের গতিবিধি ধরা পড়ে না প্রাইমারি রেডারে। এক এটিসি-বিশেষজ্ঞর কথায়, “যদি বিমানটি অক্ষত থেকে থাকে, তা হলে বলতেই হবে চালক পারদর্শিতার সঙ্গে সমস্ত রেডার এড়িয়েই গন্তব্যে নেমেছেন।”

তার পরেও এত দিন ধরে বিমানটির আর কোনও উপগ্রহ সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে না কেন? সেখানেও দু’টি সম্ভাবনা রয়েছে। এক কর্তা বললেন, “হয় কোথাও একটা বিমান নামিয়ে তার পর থেকেই ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখা হয়েছে, নয় বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়েছে।”

taliban boeing 777-200 kuala lumpur malaysia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy