Advertisement
E-Paper

গণহত্যা দিবস মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ভয়াল ২৫ মার্চ ১৯৭১-কে

আজ বাংলাদেশ গণহত্যা দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ভয়াবহ রক্তপাতের তারিখ ২৫ মার্চ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই দিন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের এক ভয়াবহ নজির তৈরি করেছিল বাংলাদেশে।

অঞ্জন রায়

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:৪১

আজ বাংলাদেশ গণহত্যা দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ভয়াবহ রক্তপাতের তারিখ ২৫ মার্চ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই দিন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের এক ভয়াবহ নজির তৈরি করেছিল বাংলাদেশে। ঢাকা শহরের নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের লাশের স্তূপগুলো পৃথিবীর মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। দুনিয়াজুড়ে মানুষের ঘৃণা আর ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিরুদ্ধে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটকে বলা হয় অপারেশন ব্লিটজ এর সিক্যুয়েল, যার উদ্দেশ্য ছিল এই ভূমির প্রধান শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে শক্তিপ্রয়োগ করে এক মাসের মধ্যে সব ধরনের রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়া। তারা মানুষ নয়, চেয়েছিল এই দেশের পোড়া আর রক্তে ভেজা মাটি।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম চমকে উঠেছিল পাকিস্তানের সেই বর্বরতার দৃশ্য দেখে। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চের গণহত্যার বিবরণে লিখেছেন, ‘সে রাতেই সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও তিন হাজার লোককে। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট, লুঠ আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হল যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন-তাড়িত শ্মশানভূমি।’

আরও পড়ুন: গণহত্যার স্বীকৃতি চেয়ে তৎপর ঢাকা

বাঙালির উপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ওই নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা হয়েছিল একাত্তরের মার্চের শুরুতেই, জুলফিকার আলি ভুট্টোর পাকিস্তানের লারকানার বাড়িতে। গণহত্যার ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া এবং জেনারেল হামিদ প্রমুখ৷ তাঁরা ভেবেছিলেন বিপুল সংখ্যার মানুষ হত্যা করলেই ভয় পেয়ে যাবে বাঙালি, থেমে যাবে এই জাতির স্বাধীনতার লড়াই।

১৯৭১-এর ২২ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনীর হাইকমান্ডের সঙ্গে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘‘৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করো, দেখবে ওরা আমাদের পা চেটে খাবে।’’ সামরিক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিল পাকিস্তান, নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। অপারেশনের মূল পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি।

১৮ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে বসে জেনারেল রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করলেন। জেনারেল ফরমান নিজের হাতে হালকা নীল রঙের একটি অফিস প্যাডের পাঁচ পাতা জুড়ে পেন্সিল দিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা লিখছিলেন। তাঁরা সিদ্ধান্তে এলেন, গোটা পূর্ব পাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু করার। অপারেশনের প্রধান কৌশল ছিল দ্রুতগতিতে আক্রমণের, যাতে সামান্য প্রতিরোধও না গড়ে ওঠে। গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে আক্রমণের সময় নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, যত বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, সাংস্কৃতিক জগতের মানুষজন, শিক্ষকদের গ্রেফতার করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলের।

অপারেশনের শুরুতেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে বাঙালি সৈন্যদের নিষ্ক্রিয় করার সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হল, বাধা দিলে সরাসরি হত্যা করার। ঢাকা শহরের সড়ক, রেল ও নৌপথের দখল নিয়ে সারা শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলার। টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফ-সহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। বিশ্ব মিডিয়ায় যাতে আক্রমণের খবর পৌঁছতে না পারে সে জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হবে।

যত্রতত্র লাশ দেখে শিউড়ে উঠেছিল গোটা বাংলা। ছবি: সংগৃহীত।

২৫ মার্চ, ১৯৭১। বাঙালির ইতিহাসে ভয়ঙ্কর রাত। সে দিন রাত ১১টায় কার্ফু জারি হয়েছিল। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ব্যারাক থেকে সেনাবাহিনী বেরিয়ে এসে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলার ঘুমন্ত, নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। শুরু হল নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল! তবে মাথা নোয়ালো না বাঙালি। রাজারবাগ, পিলখানাতে পাল্টা রুখে দাঁড়ালো পুলিশ ইপিআর সদস্যরা। শুরু হল গুলির লড়াই। সেখানে পড়ে রইল লাশের পাহাড়। গ্রেফতার করা হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের আগেই তিনি ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘোষণাটি ইপিআর-এর কাছে পৌঁছনো হয় এবং তা ইপিআর বেতারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল, ‘‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ‘৭১-এর ২৫ মার্চে রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। গত ১২ মার্চ প্রায় সাত ঘণ্টা আলোচনার পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত ভাবে এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ-সহ ৫৬ জন সাংসদ এই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিক ভাবে এই দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়া হোক। প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষে সংসদ তা গ্রহণ করলে তা কার্যকরে আদেশ দেবে নির্বাহী বিভাগ।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ও গণবিচার আন্দোলন এবং ১৪ দল সমেত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দিবসটিকে গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়ে অনেক দিন আন্দোলন চালাচ্ছিল। এ বারেই বাংলাদেশ পালন করছে প্রথম গণহত্যা দিবস।

Bangladesh Genocide Day Pakistan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy