Advertisement
E-Paper

কুয়োর ব্যাঙ হয়ে নিজেদের পায়েই কি কুড়ুল মারছে এ পার বাংলা

কেন ১৬ ডিসেম্বর আমাদের কালচারাল ক্যালেন্ডারে লাল মার্কা পায় না? কেন নিত্যনৈমিত্তিকতায় আটকে থাকে একুশে ফেব্রুয়ারি? কেন বাঙালি জাতিসত্তার এই মর্যাদার মুহূর্তগুলিকে আচ্ছন্ন করে রাখে কাঁটাতার? লিখছেন অংশুমান ভৌমিকআজ স্বদেশের বিজয় দিবসে তিরিশ বছরে পা দিল জীবন সংকেত। সিলেটের এই নাট্যদল এখন কলকাতায়। বেড়াতে নয়, পুরোদস্তুর নাটক করতে। এই দু’দিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর সন্ধেবেলায় দক্ষিণ কলকাতার নিরঞ্জন সদনে তাদের ‘জ্যোতি সংহিতা’ মঞ্চস্থ হল।

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৪
‘জ্যোতি সংহিতা’-র একটি দৃশ্য।

‘জ্যোতি সংহিতা’-র একটি দৃশ্য।

আজ স্বদেশের বিজয় দিবসে তিরিশ বছরে পা দিল জীবন সংকেত। সিলেটের এই নাট্যদল এখন কলকাতায়। বেড়াতে নয়, পুরোদস্তুর নাটক করতে। এই দু’দিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর সন্ধেবেলায় দক্ষিণ কলকাতার নিরঞ্জন সদনে তাদের ‘জ্যোতি সংহিতা’ মঞ্চস্থ হল।

যাঁরা জানেন না, তাঁদের জানাই যে কমরেড নিরঞ্জন সেনের নাম বয়ে চলা নিরঞ্জন সদনের বয়স নয় নয় করে পঁচিশ বছর হল বলে! এটির অবস্থান আদি বাম দুর্গ যাদবপুরের বুকে বিজয়গড় অঞ্চলে। অবিশ্যি বিজয়গড়কে স্রেফ ‘অঞ্চল’ বললে কম বলা হয়, কারণ কথিত আছে যে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব বাংলা থেকে সব হারিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের রণে-রক্তে-ভালবাসায় গড়া এই রিফিউজি কলোনি পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম উদ্বাস্তু উপনিবেশ। আদি নাম আরকপুর খসে গেছে কবে! খুলনা-বরিশালের শেকড় তো কবেই চারিয়ে আছে বিজয়গড়ের অলিতে গলিতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। তাই বলে সিলোডিয়া ভাইবুইনদের দেখনের লগে বিজয়গড় যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এমন নয়।

পড়লে ভাল হত।

ভাল হত, যদি তাঁরা বা তাঁদের উত্তর প্রজন্ম দেখতেন, ১৯৭১ সালে কী ভাবে দ্যাশের মাটি বাঁচানোর তরে কোমর বেঁধেছিল ভাটির দ্যাশ সিলেট। ভাল হত, যদি তাঁরা একটু কাছ থেকে বুঝতেন কী ভাবে সংগঠিত হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কী ভাবে রাজাকারদের সঙ্গে লড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। কী ভাবে ইন্ডিয়ান আর্মির ট্রেনিং নিয়ে গেরিলা ওয়ারফেয়রে পাক সেনাদের নাকানিচোবানি খাইয়েছিলেন দাস আর্মির ডাকাবুকা যোদ্ধারা। ভাল হত, যদি তাঁরা বুঝতেন কী ভাবে এই দাস আর্মির ভিত গড়ে দিয়েছিল চিনা কমিউনিস্ট পার্টি। নকশালবাড়ির বারুদ কী ভাবে ফুলকি ছড়িয়েছিল সিলেটের হাওড়ে-হাওড়ে। ভাল হত, যদি বিভাস চক্রবর্তী আর আয়োজন অনীকের সদস্য ছাড়াও এই কলকাতার থিয়েটারওয়ালাদের কেউ কেউ আজ নিরঞ্জন সদনে থাকতেন। থাকলে দেখতেন, এই একটি শো-কে সার্থক করে তুলতে কী ভাবে প্রায় গন্ধমাদন বয়ে সেই হবিগঞ্জ থেকে কলকাতায় পাড়ি দিলেন জীবন সংকেতের তরুণদল। কী ভাবে ওই ধীবর সম্প্রদায়ের ওই সাংস্কৃতিক স্বাক্ষর এই পাল্টে যাওয়া, এই পাল্টাতে থাকা কলকাতার বুকে আঁচড় কেটে গেল। ভাল হত, যদি মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসকে আরও অনেকে চিনতেন। আমরা মাস্টারদা সূর্য সেনকে চিনেছি। আমরা নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চায় সিদ্ধি লাভ করেছি। আমাদের শিল্পে তার ছাপ ফুটেছে। অথচ ইতিহাসের অভিশাপ যে আমরা জগৎজ্যোতি দাসকে চিনিনি। নূরলদিনকেও চিনেছি কি?

চিনলে দেখতাম এই ‘জ্যোতি সংহিতা’-য় রুমা মোদকের স্বপ্নালু লেখনীতে কী ভাবে এক মায়াবি নৈর্ব্যক্তিকতায় সাকার হয়েছে দাস আর্মির লড়াই। দৃশ্য-অনুদৃশ্য পরম্পরায় তাকে জঙ্গম করেছেন সুদীপ চক্রবর্তী। শক্তির সঙ্গে সঙ্গম হয়েছে স্নিগ্ধতার। সিলেটের ধীবর পল্লি উঠে এসেছে মাটির গন্ধ মেখে জলের গন্ধ মেখে ঘামের গন্ধ মেখে। মাছ ধরার জালে ছটফট করেছে ফাঁদে পড়া রাজাকারের দল। সাদা আর লাল কাপড়ের বুকে আলো পড়ে নদী হয়েছে প্রসেনিয়াম। এ সব অনেকের অদেখা রয়ে গেল। অজানা রয়ে গেল।

খুব ভাল হত, যদি আরও অনেকে বুঝতেন একটা দেশ একটা সংস্কৃতি স্রেফ একটা ‘একাত্তর’কে বুকে করে কী ভাবে বুক চিতিয়ে সামনে এগোতে চাইছে। তা বলে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবাদ পাঠকে সে ভোলেনি। ভোলেনি গোপাল দাশগুপ্তের ‘মা গো ভাবনা কেন’-র রেশ। ধ্রুবপদের মতো ফিরে ফিরে এসেছে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বুকের হাহাকার নিয়ে সুরমা নদীর গাংচিলের উড়ান। পারাপারের এই আকুলতা নিয়ে বারে বারে ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে নাট্যদল কলকাতায় আসে। আসে রাজশাহি, ময়মনসিংহ, যশোহর থেকে। শ্রীহট্ট থেকেও এল। অঘ্রানের অনুভূতিমালা নিয়ে।

কলকাতার শীতঘুম হায়, আজও ভাঙল না।

‘জ্যোতি সংহিতা’র অভিনয়ের পর বিভাস চক্রবর্তীকে সাদরে ডেকে আনা হয়েছিল মঞ্চে। জীবন সংকেতের সভাপতি অনিরুদ্ধ কুমার ধর শান্তনু তাঁর পরিচয় দিয়েছিলেন, ‘আমাদের দাদা আমাদের দেশের আমাদের অভিভাবক’ বলে। ‘আমাদের গর্ব’ বলে। তখন কি ভ্রূকুঞ্চন হয়েছিল নিরঞ্জন সদনের? নয়তো সে হাত গুটিয়ে বসেছিল কেন?

নাকি সে বুঝতেই পারেনি কোন ইতিহাসবোধ, কোন অখণ্ডিত সংস্কৃতিচেতনা থেকে ‘আমরা-ওরা’র আকচাআকচির ঊর্ধ্বে উঠে ‘আমাদের’ বলেছিলেন শান্তনু?

কী করে বুঝবে বিজয়গড়? বিস্মৃতির পলি তুলে তুলে কোন অতীতের গর্ভ ছুঁতে পারে উদ্বাস্তু আন্দোলনের এই প্রসূতিসদন? কী করে জানবে, সেই কবে, ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের পরে শ্রীহট্টকে ছেড়ে এসেছিলেন ‘জনশক্তি’ পত্রিকার সম্পাদক তথা বেঙ্গল প্রভিনশিয়াল কংগ্রেস কমিটির সদস্য বিনোদবিহারী চক্রবর্তী। স্ত্রী, পুত্রদের নিয়ে। আর চক্রবর্তী পরিবারের ১১ বছরের ছেলে বিভাস? রসময় মেমোরিয়াল স্কুল ছেড়ে, মডার্ন বুক ডিপোর রিডিং লাইব্রেরি ছেড়ে, মণিমেলার ড্রিল ছেড়ে, মহাত্মা গাঁধী নিধনের পরদিন দুর্গাবাড়ি, শাহ জালালের দরগা ছুঁয়ে চলা বিশাল শোকযাত্রা ছেড়ে, বছরে এক বার ‘সুরথ উদ্ধার’, ‘কর্ণার্জুন’, ‘কারাগার’, ‘উত্তরা’ ছেড়ে, ‘বিজয়সিংহ’ পালায় আঠা খুলে ঝুলে যাওয়া সাদা দাড়ি আর মন্ত্রীর পার্ট ছেড়ে চিরকালের জন্য এপার বাংলায় চলে আসতে হয়েছিল তাঁকেও! ৬৭ বছরের পরের বিভাস কি নিরঞ্জন সদনের মঞ্চে উঠতে স্মৃতিভারাতুর হয়েছিলেন? নির্ঘাত হয়েছিলেন।

আরও হয়েছিলেন, কারণ তাঁর দিল্লি-প্রবাসী দাদা বিকাশ, সেই রসময় মেমোরিয়াল স্কুলের উজ্জ্বল ছাত্র বিকাশ, টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে ভাই বিভাসকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ১৪ তারিখ নিরঞ্জন সদনে ‘জ্যোতি সংহিতা’র প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া কথা। গঙ্গা-যমুনা নাট্য উৎসবের মতো যে অবিশ্বাস্য নাট্য উদ্যোগ নিয়েছিল অনীক আজ থেকে উনিশ বছর আগে, প্রাণপুরুষ অমলেশ চক্রবর্তীর প্রয়াণের পরও যে উৎসবের প্রদীপ নেভেনি, সেই উৎসবের প্রাঙ্গণ কেন ভরে ওঠে না?

কারণ, অশীতিপর বিকাশ, অশীতিপর বিভাসের পরের প্রজন্ম আর এই অখণ্ড অস্তিত্বকে ধারণ করতে পারে না। শ্রীহট্টের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি তাই কলকাতায় আদর পান না।

মাসখানেক আগে, নভেম্বরের গোড়ায় বরিশালের একটি উদ্যমী নাট্যদল, নাম তার শব্দাবলী, এই কলকাতার বুকে রাসবিহারী মোড় থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে থাকা তপন থিয়েটারে তিন দিনের একটি নাট্য উৎসব করলেন। ‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’ বুকে নিয়ে হাজার হাজার লিফলেট ছড়ানো হল এ কলকাতার থিয়েটার পাড়ায়, এ কলকাতার বরিশাইল্যা প্রদেশে। চর্যাপদের গীতিকার কাহ্নপাদকে নায়ক করে ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ নাম দিয়ে যে উপন্যাস লিখেছিলেন সেলিনা হোসেন, সৈয়দ দুলালের নির্দেশনায় যার চমকপ্রদ মঞ্চায়ন করেছিল শব্দাবলী, সেটি অভিনীত হল ৬ নভেম্বর। রবিবারের সন্ধেবেলায় তপন থিয়েটার অনেকটাই ভরেছিল। ১৪ ডিসেম্বরের শীতকাতুরে নিরঞ্জন সদনের শতখানেক আসনও ভরল না।

কেন এমন হয়?

যে আকুলতা নিয়ে, যে নিরবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির উত্তরাধিকার নিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আমাদের বুকের কাছে এসে ডাক পাঠায়, সেই আকুলতা সেই উত্তরাধিকারের যোগ্য আমরা এ কলকাতা হয়ে উঠতে পারি না কেন?

কেন এ কলকাতার প্রধান তিনটি নাট্য উৎসবে বাংলাদেশের উপস্থিতি অনিবার্য হয় না? বত্রিশ বছর ধরে বাংলাদেশের নবনাট্য আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। দেশজ উৎস থেকে রস জোগাড় করে কলোনিয়াল হ্যাংওভারকে ওভার বাউন্ডারি মেরে যে বর্ণনাত্মক নাট্যধারাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রঙে ছুপিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ, আমরা তার গুণগ্রাহী না হই রসাস্বাদনে কুণ্ঠিত হব কেন? কোন কূপমণ্ডূকতা আমাদের পেছন থেকে টেনে ধরে ড্রয়িংরুম থিয়েটারের কৃষ্ণগহ্বরে পেড়ে ফেলছে? কৌম থেকে বিচ্ছিন্ন করছে? প্রথমে বাহান্ন, পরে একাত্তর, ওপার বাংলার বাঙালিকে এই উত্তরগুলি খুঁজে বের করতে প্রণোদনা দিয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার নাট্যচর্চার ভরা কোটাল কেটে যাওয়ার পর আমাদের নাট্যচর্চা থেকে দর্শন বিদায় নিতে চলেছে। এমনতর সাংস্কৃতিক বিনিময় এই পরিস্থিতিতে আমাদের সমিধ জোগাতে পারত। ঔদাস্যে নিমগ্ন হয়ে আমাদের ক্ষতিই হচ্ছে। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর অজুহাত ধোপে টিকছে না।

বুঝি না কেন এই ঘটমান বাংলা সঙ্গীতমেলায় উপেক্ষিত থাকে বাংলাদেশ? কেন বুকের পাঁজরে বাংলাদেশকে গেঁথে নিতে পারে না আন্তর্জাতিক হতে ব্যাকুলতর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব? কেন ১৬ ডিসেম্বর আমাদের কালচারাল ক্যালেন্ডারে লাল মার্কা পায় না? কেন নিত্যনৈমিত্তিকতায় আটকে থাকে একুশে ফেব্রুয়ারি? কেন বাঙালি জাতিসত্তার এই মর্যাদার মুহূর্তগুলিকে আচ্ছন্ন করে রাখে কাঁটাতার?

কিছু দিন আগে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের এক প্রাগ্রসর নাট্যজনের সঙ্গে। আর্তনাদের মতো করে তিনি বলে উঠলেন, “আমরা তো সুতপুত্র!”

সুতপুত্র! সুতপুত্র!

ওই আর্তনাদ এখনও অস্তিত্বের গহিনে গহনে অনুরণন তুলছে। অস্বীকৃতির এই অসভ্য ঔদাসীন্য আমাদের খণ্ডীভূত অস্তিত্বকেই আরও বিপন্ন করে তুলছে না তো?

ছবি: লেখক।

Victory Day of Bangladesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy