মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রাণদণ্ডের সাজা কার্যকরের পর শনিবার রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ কড়া প্রহরায় মির কাসেম আলি দেহ মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে সামহিত করা হয়েছে। এ সময় মিরের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
এ দিকে মৃত্যুর পরও অভিযোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না তিনি। নিজের ও দলের অভিযুক্ত নেতাদের মৃত্যু ঠেকাতে নাকি ২০০ কোটি টাকারও (২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার) বেশি অর্থ খরচ করেছিলেন যুদ্ধাপরাধী মির কাসেম আলি। প্রাক্তন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ এ ‘তথ্য’ জানিয়ে বলেছেন, আমেরিকার এক লবিস্ট ফার্মকে মানবতাবিরোধী বিচার বন্ধে নিয়োগ করেছিলেন মির কাসেম। ২০১০ সালে ওই ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করার পর প্রথম কিস্তি বাবদ ২০০ কোটি টাকা দেওয়ার পরে আরও অন্তত দু'টি কিস্তি দেন। প্রাক্তন মন্ত্রীর কথায় সায় দিলেন স্বয়ং অ্যাটর্নী জেনারেল মহবুবে আলম। তিনি বলেন, লবিস্ট নিয়োগের কাগজপত্র-সহ এ বিষয়টি আমরা আদালতের নজরেও এনেছি। এখন মুদ্রাপাচার আইনে মামলা করার পরিকল্পনা আছে সরকারের।
জানা গিয়েছে, মানবতাবিরোধী বিচার ঠেকানোর পরিকল্পনা করে জামাতে ইসলামির হয়ে মির কাসেম আমেরিকা ও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে নিয়োগ করেন লবিস্ট ফার্মকে। যুক্তরাষ্ট্রের ওই ফার্মটির নাম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এ ছাড়া মামলা চালাতে ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানকেও নিয়োগ করেছিলেন জামাতের এই ধনকুবের। অভিযোগ, তিনি হাত করেন কয়েকজন মার্কিন সেনেটরকে, এমনকী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকেও। তাঁরা কয়েক দফা ঢাকায় এসে এবং বিবৃতি দিয়ে এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেন।
জানা গিয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রচার চালানোর জন্য ২০১০ সালের ১০ মে কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে চুক্তি করেন মির কাসেম আলি। পরে সিটি ব্যাঙ্ক এনএ-র মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার করে চুক্তির আড়াই কোটি ইউএস ডলার ফার্মটির অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। যার অ্যাকাউন্ট নম্বর সিএমজিআরপি আইএনসি ৩০৭১৭২৪৮ এবং সুইফ্ট কোড: সিটি ইউএস ৩৩। এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মাথা প্রাক্তন মার্কিন কংগ্রেসম্যান মার্টি রুশো। প্রতি ইউএস ডলার বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮০ টাকা হিসাবে এই ট্রান্সফার করা অর্থের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা। মার্কিন এই প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ৭০০/১৩ স্ট্রিট, ১১ ডব্লিউ, সুইট-৪০০ ওয়াশিংটন ডিসি। চুক্তিপত্রেই উল্লেখ করা হয়েছে আমেরিকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ তৈরি এবং আরও নানা রকম লবিং-এর চেষ্টা চালাবে তারা। চুক্তিপত্রে জামাতের পক্ষে মির কাসেম আলি নিজে এবং লবিস্ট ফার্মের পক্ষে জেনারেল কাউন্সেল জে ক্যামেরুজ স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৬ মাস প্রচার চালানোর দায়িত্ব নেয়। প্রয়োজনে চুক্তির মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ানোর কথাও ছিল। কিন্তু এই চুক্তির এক মাসের মধ্যেই ২০১০ সালের ১৭ জুন মতিঝিল থেকে গ্রেফতার হন মির কাসেম আলি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মাত্র তিন দশকে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন মির কাসেম। ঢাকার মিরপুরে রয়েছে তার বহুতল বাড়ি। তার তত্ত্বাবধানে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাঙ্ক ঋণের পরিমাণ ২০৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এ সব ব্যবসা থেকে বিপুল আয়ের বড় একটি অংশ তিনি ব্যয় করতেন জামাতের রাজনীতির পিছনে। তবে এ সব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ সম্পদই বিভিন্ন কোম্পানি, ট্রাস্ট ও বেসরকারি সংস্থার নামে রয়েছে। বৈধভাবে আয়কর রিটার্নে তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন
ফাঁসি হয়ে গেল জামাত নেতা মির কাসেমের
সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর- যুদ্ধাপরাধী মির কাসেম আলির করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ০৭৬-১০৩-৯৬৬৩। তিনি ঢাকা কর অঞ্চল-৫-এর সার্কেল ৫০-এর করদাতা। ঢাকার মিরপুরের দক্ষিণ মনিপুরে ২৮৭ নম্বর প্লটের বহুতল ভবন তাঁর নামে। মহম্মদপুরে একতা সোসাইটির পাঁচ কাঠা জমি ও মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে সাড়ে ১২ শতক জমি রয়েছে। তিনি ধানমণ্ডির বহুতল ভবন কেয়ারী প্লাজার ১৭৮ দশমিক ৬৯ বর্গমিটারের মালিক। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মোট ৩০ হাজার শেয়ার রয়েছে তাঁর নিজের বা পরিবারের অন্য কারও নামে। এর মধ্যে ইসলামি ব্যাঙ্কের ২ হাজার ১১৩টি শেয়ার, কেয়ারী লিমিটেডের ১৪ হাজার শেয়ার, কেয়ারী টেলিকমের ১০ হাজার, কেয়ারী ট্যুরস অ্যান্ড সার্ভিসেসের ১ হাজার শেয়ার, কেয়ারী ঝর্নার ২০টি, কেয়ারী তাজের ৫টি, কেয়ারী সানের ৫টি, কেয়ারী স্প্রিংয়ের ২০টি, সেভেল স্কাইয়ের ১০০, মির আলি লিমিটেডের ২৫টি এবং দিগন্ত মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের ১০০টি শেয়ার রয়েছে মির কাসেম আলির নামে। তিনি কেয়ারী লিমিটেডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ছিলেন ইবনে সিনা ট্রাস্টের সদস্য (প্রশাসন), ইবনে সিনা হাসপাতালের পরিচালক, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্টের সদস্য ও ফুয়াদ আল খতিব চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের সদস্য।
মির কাসেমের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকা কেয়ারী লিমিটেডের নামে ব্যাংক ঋণ ৬০ কোটি ৯৩ লাখ, ইবনে সিনা ট্রাস্টের নামে ৫০ কোটি, ইবনে সিনা হাসপাতালের ৬ কোটি ৩৪ লাখ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের ২০ কোটি, দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের নামে ৪১ কোটি ৩৫ লাখ, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়ালের ২৩ কোটি ৭৫ লাখ এবং ফুয়াদ আল খতিবের নামে ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে।