সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে বদ্ধপরিকার বাংলাদেশ। —ফাইল চিত্র।
সারা বাংলাদেশের ৬৩ জেলাতে এক সঙ্গে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলো জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি। ২০০৫ সালের ১৭ অগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলা করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল তারা। তার আগে বেশ কয়েকটি বোমা হামলা চালালেও, সেটি ছিল তাদের সবচেয়ে বড় নাশকতা, যার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশে।
গত শতকের শেষ দশকে গঠিত এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি প্রকাশ্যে আসার আগে রাজশাহির বাগমারায় উগ্র বামপন্থীদের দমনের নামে অনেকগুলো নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। সেই সময়ের বিএনপি-জামাত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী তথা জামাত নেতা মতিউর রহমান নিজামি জেএমবি নেতা সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে রক্ষারও চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তী কালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সেই আল বদর নেতা নিজামির মৃত্যুদন্ড হয়েছে।
১৭ অগস্ট বোমা হামলার পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিচার বিভাগের উপর হামলা শুরু করে জেএমবি। বাংলাদেশে আত্মঘাতী হামলা এই জেএমবি-র হাত দিয়েই শুরু। অন্য দিকে এর আগেই যশোরে উদীচি শিল্পী গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে, রমনা বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে, পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির অনুষ্ঠানে, নারায়নগঞ্জে আওয়ামি লিগ অফিসে এবং আরও নানা স্থানে তারা হামলা চালিয়েছিল। শুরুতে সেই সময়ের বিএনপি-জামাত জোট সরকার এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও, দেশব্যাপী বোমা হামলা করে জঙ্গিরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। ফলে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। জেএমবি সহ চারটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের গ্রেফতার করে বিচারের কাজ শুরু হয়। বিচারক হত্যা মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসি কার্যকর হয় আমির আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই সহ জেএমবি-র ছয় শীর্ষনেতার।
২০০৮ সালে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করার পরে প্রথম দিকে এই জঙ্গিদের তেমন একটা কর্মকান্ড চোখে না পড়লেও, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার আজীবন কারাদন্ড ঘোষণার প্রতিবাদে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে অবস্থান আন্দোলন গড়ে ওঠে। পাশাপাশিই ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে থাকে অন্য একটি মহল। সেই সময়েই হত্যা করা হয় রাজীব হায়দারকে। সক্রিয় হয়ে ওঠে হেফাজতে ইসলাম নামে আরও একটি সংগঠন। শুরু হয় মুক্তচিন্তার লেখক-ব্লগার হত্যার ধারাবাহিক ঘটনা। তার পর ঘটে বেশ কয়েক জন পুরোহিত, যাজক, পিরের হত্যাকান্ড। এই সব হত্যাকাণ্ডে জেএমবি ব্যবহার করছিল চাপাতি, বোমা। কোথাও কোথাও গুলি করেও হত্যা করা হচ্ছিল। হামলা করে কয়েকজন বিদেশি নাগরিককেও তারা হত্যা করে। সব শেষে এই বছর গুলশনে হোলি আর্টিজান বেকারিতে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে এক হামলায় বিদেশি ও বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হয়। দেশে-বিদেশে আলোচিত হয় এই ঘটনা। এই হামলায় দেখা গেল জঙ্গিদের হাতে এ বার আধুনিক অস্ত্র, আধুনিক প্রযুক্তি।
প্রথম বড়সড় নাশকতা ঘটানোর পর ১১ বছর পার করে আবার আলোচনায় আসছে ২০০৫ সালের হামলাকারী সেই জেএমবির নামই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সেই জেএমবি কয়েকটি ধারায় ভাগ হওয়ার পর তার একটি এখন ‘নিও জেএমবি’ নামে সক্রিয় এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সহ কয়েকটি সংগঠন। সূত্র বলছে, জেএমবির প্রধান তামিম চৌধুরীই এই নব্য-জেএমবির প্রধান। জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে বিভিন্ন গবেষনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের সাম্প্রতিক ধারার শুরুটা হয়েছিল হরকতুল জিহাদ আল ইসলামি বা হুজির হাত ধরে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসা বাংলাদেশিরাই এ সংগঠনটি গড়ে তোলেন। ‘আমরা সবাই তালেবান-বাংলা হবে আফগান’ এই স্লোগানে মিছিল আমরা দেখেছি নিকট অতীতে।
অন্য দিকে সরকারি মদতের বিষয়টাও এ দেশে জঙ্গিবাদের বিকাশে সহায়তা করেছে, তাও খুব পরিষ্কার। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলন, ২০০১ সালে পল্টনে সিপিবির সমাবেশ ও রমনা বটমূলে বর্ষ বরণের অনুষ্ঠান, গোপালগঞ্জে গির্জা ও নারায়ণগঞ্জে আওয়ামি লিগ কার্যালয়ে হামলা, ২০০৪ সালের ২১ অগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বর্তমান প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা হয়েছিল। কিন্তু সে সব ঘটনার একটিকেও তদানীন্তন সরকার পুলিশি তদন্তের আওতায় আনেনি। ২১ আগষ্টে ঘটনায় জজ মিয়া নামের একজনকে নিয়ে নাটক বানানোর ঘটনাও ঘটেছিলো। ২১ গস্টের গ্রেনেড হামলার পরে সংসদে সরকারি দলের তরফে বলা হয়েছিল, সে সময়ের বিরোধী দলনেতা শেখ হাসিনা নিজেই ব্যাগে করে গ্রেনেড এনেছিলেন। অর্থাৎ ২১ অগষ্ট গ্রেনেড হামলার পরেও আসল অপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা হয়েছিল। এমনকী সেই হামলার নথি নষ্ট করে ফেলার ঘটনাও দেখা গিয়েছিল।
২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে তিন জেএমবি নেতাকে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নেওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসে জেএমবি। তার পর গত ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর জানা যায়, কানাডা প্রবাসী তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে সক্রিয় আছে ‘নিও জেএমবি’। তবে কল্যাণপুরে অভিযান চালিয়ে এবং শোলাকিয়ার প্রতিরোধ করে পুলিশ ও র্যাব এখন আত্মবিশ্বাসী। প্রতি দিনই তারা অভিযান করছেন, আটকও হচ্ছে জঙ্গিরা। অস্ত্র উদ্ধারও হচ্ছে। প্রতিটি সফলতায় পিছু হঠছে জঙ্গিরা।
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: রক্তক্ষরণ থামেনি বাঙালির হৃদয়ে
২০০৫ সালের ১৭ অগষ্টে ঘটনার পর পার হয়েছে ১১ বছর। এই ঘটনায় সারা দেশে ১৬০টি মামলা দায়ের হয়েছিলো। এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষার রয়েছে ৫১টি মামলা। আশা করা যায় দ্রুতই এই মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হবে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের যে শিকড়, সেটি উপড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy