তখনও পরিস্থিতি ছিল যথেষ্ট উত্তপ্ত। —নিজস্ব চিত্র।
ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরে অন্তত ছয়টি মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে বলেও অভিযোগ। রবিবার দুপুর ১২টার পর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলা এই ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। এ ঘটনার পর ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে র্যাব, পুলিশ, এপিবিএন ও বিজিবি। এছাড়া ঘটনার পর বিকালে জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান ও পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে বৈঠক করেন বিজিবির উত্তর-পূর্ব রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মাশরুর উল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান, পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান ও ইউএনও চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমদ।
পুলিশ সুপার আনন্দবাজারকে বলেন, “এখন পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। ঘটনাস্থলে ১০০ পুলিশ, এক প্লাটুন বিজিবি ও র্যাব মোতায়েন রয়েছে। সাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আগামী কাল সেখানে জেলা প্রশাসকসহ তারা সম্প্রীতি সমাবেশের আয়োজন করা হবে।”
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো ও বিডিনিউজ ২৪ ডটকমের খবরে জানা যায়, উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণ বেড় গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের এক যুবক বৃহস্পতিবার ফেসবুকে উস্কানিমূলক একটি ছবি পোস্ট করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজন ওই দিনই তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে রোববার সকালে ‘খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ নেতারা ‘নাসিরনগর আপামর তৌহিদি জনতার’ নাসিরনগর ডিগ্রি কলেজ মোড়ে বিক্ষোভের ডাক দেন। আর ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ নেতারা নাসিরনগর খেলার মাঠে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেন। পৃথক এই সমাবেশ চলার সময় মিছিল বের করে হিন্দুপাড়াগুলোতে হামলা চালানো হয়। ভুক্তভোগীদের সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ, ওই সমাবেশে যোগ দেওয়া লোকজন এই হামলা চালিয়েছে। তবে দুই সংগঠনের নেতারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, হামলার সময় মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর, আসবাব তছনছ ও প্রণামি বাক্স ভাঙচুর করে টাকাপয়সা লুঠ করা হয়। বাড়িঘর ভাঙচুর করে জিনিসপত্র লুঠ করা হয়।
মহাকাল পাড়ার গৌর মন্দিরের পুরোহিত নরেন্দ্র প্রভু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোকে জানান, আকস্মিক ভাবে এক দল যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে মন্দিরে ভাঙচুর শুরু করে। পরে তারা মূর্তিতে আঘাত করে ও লুটপাট চালায়। এ সময় তাঁকেও মারধর করা হয়। হামলায় গুরুতর আহত গৌর মন্দিরের সেবায়েত শংকর সেনকে নাসিরনগর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এরপর একই কায়দায় সদরের পশ্চিম পাড়ার জগন্নাথ মন্দির, নমশূদ্র পাড়ার কালীবাড়ি মন্দির, মহাকাল পাড়ার শিবমন্দির, দুর্গামন্দির, শীলপাড়ার লোকনাথ মন্দির, দত্তপাড়ার দত্তবাড়ি মন্দির, সূত্রধরপাড়ার কালীমন্দিরসহ এসব পাড়ার দুই শতাধিক বসতঘরে হামলা-ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।
নাসিরনগর উপজেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক খৈলকদ পোদ্দার অভিযোগ করেন, অন্তত দুই শতাধিক হিন্দু বাড়িঘর ও ১৫টি মন্দিরে হামলা চালানো হয়েছে। মারধর করা হয়েছে বেশ কয়েক জনকে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নাসিরগর উপজেলা শাখার আহ্বায়ক রিয়াজুল করিমের দাবি, তাঁদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ চলাকালে একটি পক্ষ হিন্দুপাড়াগুলোতে হামলা চালায়। তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। এ ধর্ম কখনও সংঘাতকে সমর্থন করে না। যারা এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তিনি তাদের বিচার দাবি করেন। খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নাসিরনগর উপজেলা শাখার প্রচার সম্পাদক মুফতি ইসহাক আল হুসাইন বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাবেশ করেছি। এই সমাবেশ থেকে কেউ কোথাও হামলা চালাননি।”
ইউএনও চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, স্থানীয় কওমি মাদ্রাসা ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতারা উপজেলা সদরে সমাবেশ করার অনুমতি নিয়েছিলেন। সমাবেশ চলার সময়ে এই হামলা হয়েছে। তবে সমাবেশের কেউ হামলায় অংশ নেয়নি। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। এলাকায় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেব বলেন, “বিকালের পর পরিস্থিতি দৃশ্যত শান্ত হলেও এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।”
নাসিরনগরে ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। আজ এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্সের নীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এই ঘটনা। তিনি সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy