Advertisement
E-Paper

আপামর বাঙালিকে চিরঋণী করে রেখেছে বাংলাদেশ

আবেগে-উচ্ছ্বাসে-ভাবনায় অমর একুশে। লিখছেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়আবেগে-উচ্ছ্বাসে-ভাবনায় অমর একুশে। লিখছেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০

রাজপথের দু’পাশ পলাশে শিমুলে লালে লাল। মাঝে মাঝে কোকিলের কুহুস্বর জানিয়ে দিচ্ছে— বসন্ত এসে গেছে— এ বসন্ত শুধুমাত্র ঋতু পরিবর্তনের অনিবার্যতা নয়, বসন্ত এসেছে দেশের গলি থেকে রাজপথে— আকাশে-বাতাসে— গাছে গাছে— আর মানুষের মনে মনে— প্রবল এক জয়ের উচ্ছ্বাস ঘরছাড়া করেছে সবাইকে— ফেব্রুয়ারির একুশ। এক অমোঘ এবং স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল চলেছে পায়ে পায়ে শহিদ মিনারের দিকে— ফাল্গুনের রোদ উপেক্ষা করে মানুষ হেঁটে চলেছে অবিরাম।

কুড়ি ফেব্রুয়ারির মধ্য রাত থেকে শুরু হয়েছে মানুষের এই পথ চলা। সমস্ত নদী যেমন সাগরে মেশে, তেমনই গোটা দেশ একুশেতে চলেছে মহা সঙ্গমে, শহিদ মিনারের পাদদেশে, যেখানে ঘুমিয়ে আছেন বীর শহিদ রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম-সহ আরও অনেকে। এই পথচারীদের সঙ্গে দলে দলে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী, বিভিন্ন সংগঠন, প্রেমিক, প্রেমিকা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, বাচ্চা কোলে মা, কোনও প্রতিবন্ধী একা মানুষ— কে নেই, সবাই আছেন এই মিছিলে।

ফেব্রুয়ারির একুশ দিনটা আপামর বাঙালির বড় পুণ্যের দিন, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার দিন, বিশেষ করে আজ বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার এই ঘোষণা সেই কত দিন আগেই তো ১৯৫২-র একুশ তারিখে রক্তের অক্ষরে লিখে দিয়েছিলেন ওঁরা— তাই হাঁটছে মানুষ লক্ষ্য শহিদ মিনার— ভাষা স্মারক স্মৃতিসৌধ— কত মানুষ খালি পায়ে হেঁটে চলেছেন হাতে ফুল নিয়ে। বাঙালির পূর্ণ পবিত্র তীর্থে চলেছে।

ফ্ল্যাশব্যাকে আর এক বসন্ত, লাখ লাখ মানুষ সে দিনও মিছিল করে হেঁটে এসেছিলেন, জনসমুদ্রে লেগেছে জোয়ার, সকলের গতিপথ একই দিকে, অনিবার্য, অবিরাম, সে দিনও ছিল। একের পর এক মানুষের ঢেউ এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে রাজপথ, বসন্তের চড়া রোদ হার মানছে মানুষগুলোর হৃদয়ের উষ্ণতার কাছে।

ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জই নয় শুধু, পূর্ব পাকিস্তানের দূর দূর অঞ্চল থেকে মানুষ আসছেন—আসছেন মহম্মদ আলি জিন্নাকে দেখতে, তাঁর কথা শুনতে।

রেসকোর্সের মাঠে সে দিন তিলধারণের জায়গা নেই, সবার গলায় একই স্লোগান— কায়েদ-ই আজম জিন্দাবাদ। দেশ ভাগ হওয়ার পর প্রথম ঢাকা শহরে আসা মহম্মদ আলি জিন্নার ১৯৪৮-এর ২১ মার্চ। তিনি মঞ্চে উঠলেন, উল্লাসে, উৎসাহে, সকলের মিলিত চিৎকার যেন সমুদ্র গর্জনকে হার মানায়। তিনি কথা শুরু করলেন উর্দু আর ইংরাজি মিশিয়ে। জনতার হাততালি যেন কিছুতেই আর থামে না। স্বাধীন দেশের নেতার জন্য সকলের হৃদয়ে অনন্ত ভালবাসা আর অফুরান প্রত্যাশা।

কিন্তু হঠাৎ মণির মতো উজ্জ্বল নীল আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এল! এ কি বললেন তিনি! উর্দু অ্যান্ড উর্দু ওনলি শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাংগুয়েজ অফ পাকিস্তান— লাহোর রেজলিউশনের স্টেটস-এর ‘এস’ ছাপার ভুল— একটা এস-এর বিলোপে পাকিস্তান হয়ে গেল এক রাষ্ট্র এক ভাষা এক সংস্কৃতির দেশ।

জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে বাড়ি ফিরল। ফেরার পথে নেই কোনও উচ্ছ্বাস, নেই কোনও কলরব। স্বাধীন দেশের জনতার স্বপ্ন যেন ভেঙে খান খান করে দিয়েছেন তাদের রাষ্ট্রনেতা।

পর দিন। কার্জন হল। মহম্মদ জিন্না আজ ইংরাজিতে বক্তৃতা করছেন। গতকালের কথাই পুনারবৃত্তি করতেই ছাত্র এবং জনতার একাংশ প্রতিবাদ এবং ক্ষোভে ফেটে পড়ল। পর মুহূর্তে অগণিত কণ্ঠস্বর এই প্রতিবাদে সামিল হল আর এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানের কোণে কোণে। দলে দলে ছাত্ররা গান গাইল— ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’।

নিজেদের ভিতর অনেক আলাপ-আলোচনা, তর্ক-মতান্তরের পর সর্বদলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই—কারণ মাতৃভাষার অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে।

একুশে ফেব্রুয়ারির আহ্বান পৌঁছে গেল ঘরে ঘরে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্ল্যাকার্ড লিখল, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই— কাগজের ব্যাজ পরিয়ে দিল সাধারণ জনগণকে। ব্যাজ পরবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। সংগ্রামে অর্থ সাহায্যের জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল— গোটা দেশের জনসমর্থন সঙ্গে রইল ছাত্রছাত্রীদের।

সরকার ১৯৫২-র ২০ ফেব্রুয়ারি এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করে দিল। সর্বদলীয় বৈঠকে একাংশ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত ছাত্র-প্রতিনিধিরা জানিয়ে দেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখর করে ২১ ফেব্রুয়ারির দিন সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হলে পুলিশ অস্ত্র হাতে চার দিক ঘিরে ফেলে।

বেলা সওয়া এগারোটা—ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশের টিয়ার গ্যাস ভরদুপুরেই সন্ধে ঘনিয়ে তোলে। উপাচার্য পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস না ছোড়ার অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ছাত্ররা ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে ফেলে।

বেলা তিনটে নাগাদ পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। ছাত্ররা ওই উদ্দেশ্যে আইনসভার দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ গুলি বর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে আব্দুল জব্বার এবং রফিকউদ্দিন আহমেদ শহিদ হন।

ছাত্রহত্যার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ জনতা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দেয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের পায়ে এসে দাঁড়ান জনতা। ঘটে য়ায় এক ঐতিহাসিক আন্দোলন।

এর মধ্যেই পুলিশের গুলিতে একটি কিশোরের মায়াবী চোখ দুটো বুজে এল, তার গায়ের জামাটি রক্তে ভেজা— ভাষা আন্দোলনের একজন কিশোর শহিদ অহিউল্লাহ। ছাত্র-হত্যার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল—কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস দোকানপাট যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়। একে একে মারা যান বরকত, সালাম এবং আরও অনেকে। আরও যে কত জনের জীবন প্রদীপ নিভে গেল সময়ের দলিল কি সেই তথ্যের সঠিক হিসেব দিতে পেরেছে আজ অবধি?

প্রাণ গেল কিন্তু আন্দোলন থামল না—সাড়ে চার কোটি মানুষের আওয়াজ উঠল।

একুশে রাত ভোর হল— এল নতুন সকাল— আন্দোলনের ঢেউ ঢাকা শহর থেকে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ল।

ভাষা আন্দোলন জয়ী হল— একটা স্বাধীন দেশ নিজেদের মাতৃভাষার অধিকার পেল। এখন আমরা রাজপথ ছেড়ে শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে, গোটা দেশ যেন ভেঙে পড়েছে এই প্রাঙ্গনে। প্রত্যেকেই ভাষা শহিদের স্মৃতিতে ফুল দিয়ে পুণ্য অর্জন করতে চান। বাংলাদেশ গোটা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস— সেই পুণ্য এসেছে বাঙালি এবং বাংলার হাত ধরে। বিশ্বের দরবারে মাতৃভাষার এই মর্যাদা সে তো ওই বাংলদেশেরই দান। আর আপামর বাঙালিকে এই ভাবেই চিরঋণী করে রেখেছে বাংলাদেশ।

শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে এখন এক অনির্বচনীয় দৃশ্য— সকলেই শরীরে দুঃখিনী বর্ণমালা জড়িয়ে এগিয়ে আসছেন— কারও গালে শহিদ মিনারের ছবি আঁকা, কারও কপালে বাংলাদেশের পতাকা জ্বলজ্বল করছে। সারা শরীরে অ-আ-ক-খ আঁকা পোশাক।

একটা ভাষাকে ভালবেসে এত মানুষের সমাগম— এত মানুষের জোয়ার চোখে না দেখলে কি বিশ্বাস হত?

ভাষা শহিদ স্মারক সৌধে অগুনতি মানুষ ফুলমালা দিচ্ছেন— শ্রদ্ধায় অবনত হচ্ছে উত্তরপুরুষের কাছে— পরম্পরার কি অলৌকিকতা।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ভুলে মানুষ আজ এক সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছেন আলোকস্তম্ভের দিকে— ওই স্মৃতিসৌধ তো আসলে আলোকস্তম্ভ— বাঙালির লাইটহাউস! ওই লাইটহাউসটি হয়তো শেষ পর্যন্ত মুছে দিতে পারবে মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদ। আপাত বসন্ত যাত্রার ভেতরে ভেতরে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকে গভীর শোক— যে মানুষগুলো দু’চোখ ভরে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাঁরা আজ কোথাও নেই, তাঁরা তাঁদের স্বপ্নপূরণ দেখে যেতে পারেননি।

যাঁরা এক দিন উত্তর প্রজন্মের জন্য একটা নতুন পৃথিবী উপহার দিয়ে গেছেন সেই উত্তর প্রজন্ম এই উৎসবের অন্তরালে গোপনে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলছেন তো? ওই চোখের জলটুকুই হবে সে দিনের সোনার মানুষগুলোর প্রতি যথার্থ ঋণ স্বীকার।

শহিদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে ভাষা আন্দোলনের অমর সঙ্গীত ভেসে আসছে—

‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি’’

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-য় পুলিশের গুলি ছোড়ার ঘটনার পর ২১ নিয়ে প্রথম গান আব্দুল গাফফর চৌধুরীর এই অমর সঙ্গীত শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে জড়ো হওয়া অগণিত মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা। দূরে একটি কিশোর তখন সমস্ত শরীর এবং মন দিয়ে আবৃত্তি করছে,

‘‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি

তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’’

অমর একুশ চিরকাল থাকবে বাঙালির হৃদয়ে— আর এ ভাবেই বাঙালি বাংলা ভাষার জয়পতাকাটি এগিয়ে নিয়ে যাবে আগামীর দিকে।

(লীনা গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও চিত্রনাট্যকার)

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy