Advertisement
E-Paper

সকলের ভাল চেয়েই সূচনা ব্যাঙ্ক বিপ্লবের

উদ্বোধনী বিজ্ঞাপনে লেপ্টে থাকা এই শব্দবন্ধকেই ব্যবসার মূল মন্ত্র করছে বন্ধন ব্যাঙ্ক। স্বাধীনতার পরে রাজ্য তথা পূর্ব ভারতের প্রথম ব্যাঙ্ক হিসেবে যাদের পথ চলা শুরু হল ছুটির দিন রবিবারে। উদ্বোধন করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি।

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৫ ০২:৫৯
ব্যাঙ্ক উদ্বোধনে কেন্দ্র এবং রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে চন্দ্রশেখর ঘোষ। ছবি: এএফপি।

ব্যাঙ্ক উদ্বোধনে কেন্দ্র এবং রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে চন্দ্রশেখর ঘোষ। ছবি: এএফপি।

আপকা ভালা। সবকি ভালাই।

ভাল আপনার। ভাল সবার।

উদ্বোধনী বিজ্ঞাপনে লেপ্টে থাকা এই শব্দবন্ধকেই ব্যবসার মূল মন্ত্র করছে বন্ধন ব্যাঙ্ক। স্বাধীনতার পরে রাজ্য তথা পূর্ব ভারতের প্রথম ব্যাঙ্ক হিসেবে যাদের পথ চলা শুরু হল ছুটির দিন রবিবারে। উদ্বোধন করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। আই-প্যাডে তিনি আঙুল ছোঁয়াতেই এক লপ্তে চালু হয়ে গেল ৫০১টি শাখা। যার ২২০টিই এই রাজ্যে।

ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষের দাবি, অধিকাংশ ব্যাঙ্কের তুলনায় আমানতে সুদ দু’পয়সা বেশিই দেবেন তাঁরা। সেভিংস অ্যাকাউন্টে ৪.২৫%। জমা লক্ষ টাকা ছাড়ালে আর একটু বেশি, ৫%। ৮.৫% সুদ মিলবে এক থেকে তিন বছরের মেয়াদি আমানতেও। অঙ্ক সহজ। বেশি সুদের চুম্বকে যত বেশি আমানত ব্যাঙ্কের ঘরে জমা পড়বে, তত সহজ হবে গরিবগুর্বোদের ঋণে সুদ কমানো। কিছুটা সস্তায় ধার দেওয়া যাবে তাঁদের। ক্ষুদ্রঋণ পেতে আজ প্রায় দেড় দশক বন্ধন-কে চোখ বন্ধ করে ভরসা করেছেন যাঁরা।

বছর চোদ্দো আগে সাইকেলে প্যাডেল ঘুরিয়ে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা শুরু করা চন্দ্রশেখরবাবু বলছেন, ‘‘ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা হিসেবে গরিব মানুষকে এত দিন শুধু ঋণ দিয়েছি। আমানত সংগ্রহের জো ছিল না। তাই ব্যাঙ্ক থেকে ১৩-১৪ শতাংশ সুদে ধার নিয়ে ঋণ দিতে হয়েছে সেই টাকায়। আমানত এলে, মূলধন সংগ্রহের খরচ কমবে। ধীরে ধীরে কমানো যাবে সুদও।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘আমাদের ব্যাঙ্কে টাকা রেখে আপনি সুদ বেশি পাচ্ছেন। তাতে আপনার ভাল। আবার সেই টাকায় কিছুটা সস্তায় ধার পাবেন প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ। ফলে ভাল সবারই।’’ যেন বিজ্ঞাপনের বয়ান মিলে যাচ্ছে হুবহু।

তিনি নিশ্চিত, মুম্বইয়ের ব্যাঙ্ক কর্মীর জমা দেওয়া টাকায় বনগাঁয় বেতের ঝুড়ি বোনা গৃহবধূকে ধার দেওয়ার এই সমীকরণ মিলবেই। আর সেই আত্মবিশ্বাসেই এ দিন থেকে সুদ কমেছে নতুন ব্যাঙ্কের নতুন ক্ষুদ্রঋণে। ২২.৪% থেকে ২১%।

চন্দ্রশেখরবাবুর বিশ্বাস, অজ পাড়া-গাঁয়ে কখনও স্কুলে পা না-রাখা চাষিও আগামী দিনে দ্রুত আঁকড়ে ধরবে প্রযুক্তিকে। হাতে ধরা স্মার্টফোনের বোতাম টিপে সহজেই টাকা পাঠাবে অন্যত্র। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থোক টাকা কোঁচড়ে বেঁধে হাটে যাওয়ার প্রয়োজন আর থাকবে না। সেই বিপ্লবে বিশ্বাস রেখেই এ দিন ব্যাঙ্কের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) চালু করার কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। পরিকল্পনা করছেন, প্রত্যন্ত গ্রামেও মোবাইল মারফত নগদহীন (ক্যাশলেস) লেনদেনকে জনপ্রিয় করে তোলার।

বিপ্লব। অনেকেই বলছেন হঠাৎ যেন ঝোড়ো বদল আসছে দেশের ব্যাঙ্কিং শিল্পে। আচমকাই শহরতলি আর গ্রামের দিকে নজর পড়তে শুরু করেছে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির। যেন এই প্রথম দুয়োরানির ডাক পড়ছে রাজ দরবারে। নেপথ্যে কারণ মূলত দু’টি। প্রতিযোগিতা আর প্রযুক্তি।

গত ১৯ অগস্ট পেমেন্টস ব্যাঙ্ক খুলতে ১১ আবেদনকারীকে নীতিগত ভাবে অনুমোদন দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এর মধ্যে ডাক বিভাগের মতো সরকারি সংস্থা যেমন রয়েছে, তেমনই আছে রিলায়্যান্সের মতো কর্পোরেট দৈত্য। আছে ভোডাফোন, এয়ারটেল, টেক মহীন্দ্রাও। বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ, এমনকী খোদ অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও মনে করেন, দেশে ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় বিপ্লবের সূচনা হবে পেমেন্টস ব্যাঙ্কের হাত ধরে। যার প্রধান হাতিয়ার হবে প্রযুক্তি। কারণ, ব্যবসা করতে পেমেন্টস ব্যাঙ্ক সব জায়গায় শাখা খুলবে না। বরং আঁকড়ে ধরবে ইন্টারনেটকে। তাতে খরচ কমবে। দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছনোর পথে এত দিন যা মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়বে প্রতিযোগিতাও। অনেকে বলছেন, প্রতিযোগিতা আর প্রযুক্তির এই চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারেন চন্দ্রশেখরবাবুরাও।

বন্ধন ব্যাঙ্কের উদ্বোধনে জেটলি বলছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই জন্ম হল এক অসাধারণ প্রতিষ্ঠানের। যারা পরিষেবা শুরুই করছে প্রত্যন্ত গ্রামেও প্রতিটি দরজায় পৌঁছনোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বড় কর্পোরেট সংস্থার বদলে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগকে পুঁজি জোগানোই যাদের পাখির চোখ। তাঁর মতে, এ ধরনের ব্যাঙ্ক যত তৈরি হবে, বেআইনি লগ্নি সংস্থায় টাকা রাখা থেকে তত সরে আসবেন মানুষ।

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, গ্রামের মানুষের হাতে টাকা জমা দেওয়ার মতো অর্থ আছে। আছে টাকা এক জায়গা থেকে অন্যত্র পাঠানোর চাহিদা। মাথাপিছু অঙ্ক ছোট হলেও, সব মিলিয়ে এই বাজার নেহাত মন্দ নয়। খরচে কুলনো সম্ভব হয় না বলে, এত দিন শাখা খুলে এই বাজার ধরা যায়নি। কিন্তু এ বার প্রযুক্তির অস্ত্রে তা দখল করতে কোমর বাঁধছে বড়-ছোট সব ব্যাঙ্কই।

এ বিষয়ে চন্দ্রশেখরবাবুর দাবি, তাঁরা ব্যাঙ্কিংয়ে নতুন। কিন্তু এই বাজারে পুরনো। কারণ, এখানেই তো গত দেড় দশক ধার দিয়ে আসছেন তাঁরা। বরাবর ফেরত পেয়েছেন সেই ধারের ৯৯.৯%! দেশের তাবড় ব্যাঙ্ক যখন বহু শিল্প সংস্থার কাছে সময়ে ধারের টাকা ফেরত পেতে খাবি খাচ্ছে, তখনও গরিব মানুষকে দেওয়া ধার মার যায়নি বললেই চলে।

বন্ধন ব্যাঙ্কের দু’টি বিভাগ। একটি ক্ষুদ্রঋণের (মাইক্রো ক্রেডিট)। অন্যটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কিং। এর মধ্যে প্রথমটি কাজ করবে আগের মতো। সারা দেশে ২০২২টি শাখা, প্রায় ১৫ হাজার কর্মী এবং বাড়ি-বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার পরিকাঠামো নিয়ে তারা ঋণ দেবে অসচ্ছল মানুষদের। সব্জির ব্যবসা হোক বা ছাগল পোষা— যে কোনও ছোট উদ্যোগের জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে ধার চাইলে, এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ মিলবে সে রকম বন্ধক ছাড়াই। আর ব্যাঙ্কের অন্য অংশটি কাজ করবে অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের ধাঁচে। সেখানে সেভিংস অ্যাকাউন্ট বা দীর্ঘ মেয়াদি আমানতে টাকা রাখা যাবে। মিলবে বাড়ি ঋণ, গাড়ি ঋণ। তবে সেখানেও লক্ষ্য হবে, দামি ফ্ল্যাট কিনতে টাকা জোগানোর আগে গরিবদের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের বন্দোবস্ত করার।

কিন্তু দেশের এত রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি, বিদেশি, পেমেন্টস ব্যাঙ্কের ভিড়ে কী ভাবে নিজের জায়গা করে নেবে বন্ধন? বেআইনি লগ্নি সংস্থায় হাত পোড়ার পরে আনকোরা নতুন ব্যাঙ্কে কোন ভরসায় টাকা রাখবেন গ্রামের মানুষ?

চন্দ্রশেখরবাবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘‘যোগাযোগ।’’ ২০০১ সালে কোন্নগর-বাগনানে জনা দুই কর্মী আর কাঠের একটি টেবিল নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা চালুর দিন থেকে আজও যা একই আছে। তিনি বলছেন, ‘‘অনেক ব্যাঙ্কের কর্মী গ্রামে যেতেই চান না। অথচ আমাদের অধিকাংশ কর্মী সেখানেই বেশি স্বচ্ছন্দ। ফি সপ্তাহে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের সঙ্গেও ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করেন তাঁরা।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘রোদে-জলে ভিজে এত দিন ধারের টাকা যদি পৌঁছে দেওয়া যায়, এ বার তবে গ্রামের মানুষকে হাতে ধরে শিখিয়ে দেওয়া যাবে অ্যাপের ব্যবহারও। এই আস্থা আপনি কাড়বেন কী ভাবে? কেন সেই ব্যাঙ্কে টাকা রাখবে না আমজনতা?’’ চন্দ্রশেখরবাবুর দাবি, ব্যাঙ্ক চালুর দিনেই ১.৪৩ কোটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৭৪ লক্ষ টাকা রাখার। ৬৯ লক্ষ ধারের। জমা পড়েছে ৮০ কোটি টাকা। আগামী দিনেও তাঁদের অধিকাংশ শাখা গ্রামে হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা হিসেবে গ্রামের বাড়ির হেঁশেলে ঢুকে পড়া এক কথা, আর সম্পূর্ণ অন্য গল্প পুরোদস্তুর ব্যাঙ্ক হিসেবে পরিষেবা দেওয়া। সেখানে নিয়মের বাঁধন অনেক বেশি কড়া। প্রতিযোগিতা অনেক তীব্র। হয়তো সেই কারণে অভিনন্দনে ভরিয়ে দিয়েও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। প্রশ্ন করেছেন, ‘‘ব্যাঙ্ক হওয়ার পরেও রাজ্য থেকে তোলা আমানতের টাকা বন্ধন এখানেই ধার দেবে তো? একই রকম প্রাধান্য পাবে কৃষি, স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ধার দেওয়া? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সব নিয়ম মানার পরেও ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত ধারের টাকা তুলে রাখতে পারবেন তো চন্দ্রশেখরবাবু?’’ বার্তা স্পষ্ট, ব্যাঙ্ক হওয়া নিয়ে আত্মতুষ্টির দিন আজই শেষ। এ বার লড়াই ‘অন্য’ ব্যাঙ্ক হওয়ার।

চন্দ্রশেখরবাবুর কাছে এই লড়াই আসলে শিকড়কে না-ভোলার। তাই মন্ত্রী-সেলিব্রিটি ব্যাঙ্কার-আমলা ঠাসা এ দিনের প্রেক্ষাগৃহেও ৩০০ জন পুরনো ঋণগ্রহীতাকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তাঁদের সম্বোধনও করেছেন নিখাদ বাংলায়। বলেছেন, ‘‘আজ আপনাদের জন্যই আমরা এখানে। আমি কৃতজ্ঞ।’’

পারিবারিক মিষ্টির দোকানে রোজ রুটি বেলা, সামান্য বেতনের চাকরি, গয়না বেচে ব্যবসা শুরুর অতীত থেকে আস্ত একটি ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা-কর্ণধার। এ দিন দেখা গেল, এই রূপকথার উড়ানেও বিন্দুমাত্র সন্তুষ্টি নেই চন্দ্রশেখরবাবুর। নইলে ব্যাঙ্ক উদ্বোধনের দিনেই তাকে পৃথিবীর সেরা ব্যাঙ্ক বানানোর ডাক তিনি দেবেন কেন? কেনই বা জেটলিও ‘চমকে’ যাবেন বুদ্ধিজীবীর বাংলা থেকে এমন আগ্রাসী বাঙালি উদ্যোগপতিকে বেরোতে দেখে?

কোনও এক গুরুভাই দেশাইয়ের কথা মনে পড়ে?

bandhan chandrashekhar ghosh indrajit adhikari best wishes good wishes bandhan arun jaitley bandhan good wishes bandhan blue colour bandhan bank abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy