নির্মলা সীতারামন
জটায়ু ওরফে লালমোহনবাবু থাকলে নির্ঘাৎ বলতেন, ‘‘কী কাণ্ড মশাই! শেষে কি না সঞ্চয়ে সঙ্কট!’’
শেয়ার বাজারে ধস। বহু ফান্ডের (বিশেষত শেয়ার নির্ভর বা ইকুইটি) ন্যাভ তলানিতে। ব্যাঙ্কে সুদ বাড়ন্ত। চাপে বন্ড বাজারও। এই ‘চক্রব্যূহে’ দাঁড়িয়ে টাকা রাখার জায়গা খুঁজে পেতে খাবি খাচ্ছেন বহু কষ্টে দু’পয়সা জমানো সাধারণ মানুষের বড় অংশ। ডাকঘর, ব্যাঙ্কে সুদ কমায় তাঁরা কোথায় টাকা জমাবেন, সেই প্রশ্ন উঠছিল বহু দিন ধরেই। যা আঁচ করে খোদ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছিলেন, ‘‘ডাকঘর, ব্যাঙ্ক, মেয়াদি আমানতেই যে জমাতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা তো নেই! বন্ড বা শেয়ারে রেখেও একই বা বেশি আয় করতে পারেন।’’ সদ্য শেয়ারে বিপুল ক্ষতির মুখ দেখা এক লগ্নিকারী বলছেন, ‘‘বাজার তলিয়ে যাওয়ার পরে ওই কথা যেন ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে।’’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব জুড়ে শেয়ার বাজারে ধস মূলত করোনার কামড়ে। দুনিয়ার বাজারকে দু’দিনে এমন শুইয়ে দেওয়ার ঘটনা কখনও-সখনওই ঘটে। তবে তাঁরা মানছেন, বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে এমন উটকো ঝুঁকি বাড়বে। পৃথিবীর এক প্রান্তের বিপর্যয় পথে বসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে অন্য প্রান্তের মানুষকে। কিন্তু ভারতের আর্থিক বাজার ও লগ্নিকারীরা সেই ঝুঁকি সামলাতে কতটা তৈরি, সে বিষয়ে সন্দিহান অনেকে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসির (এনআইপিএফপি) অধ্যাপক এন আর ভানুমূর্তির প্রশ্ন, ‘‘সঞ্চয়ের রিটার্ন যে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতার উপরে নির্ভরশীল, তা সকলে জানেন। তাই শেয়ার-ফান্ডে লগ্নির ঝুঁকি নেওয়া, মূল্যবৃদ্ধির হারকে টপকে বাড়তি রিটার্নের আশায়। কিন্তু বাজার কী ভাবে ওঠে-নামে, কী করে ওঠে-পড়ে ফান্ডের ন্যাভ, তার স্পষ্ট ধারণা আছে ক’জনের?’’ তাঁর অভিযোগ, এ নিয়ে সরকার বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সচেতনতা তৈরির উদ্যোগও কম।
সমীক্ষায় স্পষ্ট, গ্রাম-মফসস্ল দূর, শেয়ার-ফান্ডের স্বচ্ছ ধারণা নেই বড় শহরের বহু সঞ্চয়কারীর। ফলে প্রশ্ন ওঠে, ব্যাঙ্কে লাগাতার সুদ ছাঁটাই কি তাঁদের ক্ষমতার তুলনায় বেশি ঝুঁকি নিতে বাধ্য করছে? এনআইপিএফপি-র অধ্যাপক লেখা চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘মানুষকে খরচে উৎসাহ দেওয়া না কি সঞ্চয়ে—কোন পথে হাঁটা উচিত, সরকারের আর্থিক নীতিতে এ নিয়ে দ্বিধা স্পষ্ট। খরচে উৎসাহ জোগাতে ব্যাঙ্কে সুদ কমেছে। তা নিম্নমুখী ইপিএফ-সহ স্বল্প সঞ্চয়েও। কিন্তু উন্নত দুনিয়ার মতো সুদ শূন্যের দিকে হাঁটলে, মানুষ বিপদে পড়বেন।’’
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতির মতে, ‘‘দেশে পণ্য-পরিষেবার চাহিদা বাড়ন্ত। তাই লগ্নিতে টান। ফলে ঋণের চাহিদাও কম। ব্যাঙ্ক বেশি সুদ দেবে কোথা থেকে?’’ কিন্তু সুদ-নির্ভর কম ঝুঁকির প্রকল্পে টাকা রাখার বিকল্প কমলে, এমন বিপর্যয়ে ক্ষতি বাড়বে।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টাকা রাখায় জোর দিচ্ছেন লগ্নি বিশেষজ্ঞ শৈবাল বিশ্বাসও। তাঁর মতে, ‘‘সঞ্চয় করা উচিত সব রকম ‘বালতিতে’ জল রেখে। যাতে একটি সমস্যায় পড়লে, তা সামলায় অন্য বিনিয়োগ।’’ তাঁর পরামর্শ, ‘‘হঠাৎ আছড়ে পড়া বিপদে বিপুল ক্ষতি গুনে তড়িঘড়ি সব টাকা তুলে নেওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনই উচিত নয় লোভে পড়ে নতুন করে বেশি টাকা ঢালাও।’’ বরং পরিস্থিতিতে নজর রেখে ‘ধীরে চলো’ নীতিকে আঁকড়ে ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy