বিনিয়োগের বাজারে আবহাওয়া বদলাচ্ছে চোখে পড়ার গতিতে। তা শুরু হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। মূলত করোনায় সাধারণ মানুষের একাংশের আয় এবং সঞ্চয় বড়সড় ধাক্কা খাওয়ার পরে। ব্যাঙ্ক-ডাকঘরে কম সুদের জমানায় তাঁদের অনেকেই তখন লোকসানের বিরাট ঝুঁকি রয়েছে জেনেও শেয়ার এবং মিউচুয়াল ফান্ডের জগতে ঢুকছিলেন। এই ঝোঁক হালে আরও গতি পেয়েছে। মূল কারণ, গত পাঁচ বছরে শেয়ার এবং ফান্ড থেকে পাওয়া অতি আকর্ষণীয় রিটার্ন। সঙ্গে আছে করছাড়ের সুবিধা, একটু বড় মেয়াদে সম্পদ তৈরির সুযোগ, দেশীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাল ইঙ্গিত ইত্যাদি। তার উপর ব্যাঙ্ক-ডাকঘরের সুদ কম। ফলে বিনিয়োগের ওই সনাতন জায়গা থেকে জমার বড় অংশ সরে আসছে শেয়ার এবং ফান্ডে।
কোভিড হানা এবং লকডাউনের কারণে ২০২০-র মার্চে সেনসেক্সে নেমেছিল ২৬ হাজারের কাছে। তবে তার পর থেকে ক্রমাগত বেড়ে ২০২৪ এর সেপ্টেম্বরে পৌঁছয় প্রায় ৮৬ হাজারে। অর্থাৎ সাড়ে চার বছরে বৃদ্ধি ৩.৩০ গুণ। কমবেশি একই রিটার্ন দেয় শেয়ার ভিত্তিক ফান্ড। এর পরের কয়েক মাসে শেয়ার দরে কিছুটা সংশোধন হয়েছে। তবু তা এখনও ৮২ হাজারের আশপাশে। দ্রুত বাড়ছে লগ্নিকারী এবং ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট। বিএসই তে নথিবদ্ধ লগ্নিকারী এখন ২২.১৭ কোটি। জুনে ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৯.৬৬ কোটি। শুধু মে মাসেই যোগ হয়েছে ২২ লক্ষ অ্যাকাউন্ট। ২০১৯-এ ছিল মাত্র ৩.৬ কোটি। গত শুক্রবার বিএসই-তে নথিবদ্ধ সব শেয়ারের মোট বাজার দর ছোঁয় ৪৫৮.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। শেয়ার মূল্যের ভিত্তিতে বিশ্বে এ দেশ চতুর্থ। সব ফান্ডের পরিচালিত মোট সম্পদও (এইউএম) পৌঁছেছে ৭৪.৮৯ লক্ষ কোটি টাকায়। অন্য দিকে, গত অর্থবর্ষে ডাকঘরের স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে গচ্ছিত ছিল কমবেশি ৩৪.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা। ব্যাঙ্কগুলির কাছে গত ডিসেম্বরে মেয়াদি জমা খাতে তার পরিমাণ ছিল ২১৭.১১ লক্ষ কোটি টাকা।
শেয়ার বাজার খুবই অনিশ্চিত এবং ঝুঁকির। তবু এখানে লগ্নি বাড়ছে। বাজারে প্রথম শেয়ার ছেড়ে তহবিল সংগ্রহে (আইপিও) নামছে বিভিন্ন সংস্থা। সেগুলিতে শেয়ার কেনার আবেদনও জমা পড়ছে কয়েক গুণ। এসআইপি-র রাস্তায় ফান্ডে প্রতি মাসে কমবেশি ২৫ হাজার কোটি টাকার লগ্নি ঢুকছে। এর একটি বড় অংশ খাটছে শেয়ারে। যা বাজারকে চাঙ্গা রাখছে।
অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় অল্প বয়সিদের মধ্যে বাজার নিয়ে উৎসাহ। কম্পিউটার বা স্মার্টফোনেই এখন লগ্নির কাজ সারা যায়। আর অল্প বয়সিরা প্রযুক্তিতে দক্ষ। বাজার সংক্রান্ত খবরাখবরও মেলে নিমেষে। তার উপর সেবির কড়া নিয়ন্ত্রণে বাজার এখন অনেক বেশি স্বচ্ছ। নতুন প্রজন্ম বুঝতে শিখেছে, ঝুঁকি থাকলেও সব জেনে বুঝে সঠিক সময়ে লগ্নি করলে তাকে বাগে রাখা যায়। পুরোপুরি ফাটকায় না নামলে আগের মতো শেয়ারের লগ্নিতে সর্বস্বান্ত হতে হয় না। যে কারণে ঝাঁকে ঝাঁকে কম বয়সিরা ঢুকছে শেয়ার এবং ফান্ডের দুনিয়ায়।
প্রবীণদের কেউ কেউ আয় বাড়াতে ঝুঁকি নিচ্ছেন বটে। তবে সিংহভাগই সতর্ক। যদিও তাঁদের সুরক্ষিত সঞ্চয়ের কিছু অংশও ঘুরপথে শেয়ারেই খাটছে। পিএফের টাকার একাংশ শেয়ারে লগ্নি বাধ্যতামূলক। এনপিএস তহবিলের ক্ষেত্রেও জমার একাংশ খাটে শেয়ার বাজারে। এলআইসিতে জীবন বিমার প্রিমিয়ামের কিছুটাও লগ্নি হয় শেয়ারে। ২০২৪-এর মার্চে কর্মী পিএফ তহবিলে মোট জমা ছিল আনুমানিক ২৪.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা। ইটিএফ মারফত শেয়ারে লগ্নির মূল্য প্রায় ২.৩৫ লক্ষ কোটি। গত জুনে ১৫.৭২ লক্ষ কোটি টাকা ছোঁয় এলআইসি-র লগ্নি করা বিভিন্ন শেয়ারের মোট মূল্য।
(মতামত ব্যক্তিগত)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)