কোভিড শুধু আমাদের শারীরিক আর মানসিক ভাবেই কাবু করেনি, বাজারকেও পঙ্গু করে দিয়েছে। কেউ বলছেন, এটা সাময়িক। আবার কেউ বলছেন, এর চাপে আমরা বহু দিন ভুগব। ঠিক কত দিন? এর উত্তর কেউই দিতে পারছেন না। তার কারণ সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই ধরনের বিধ্বংসী, সর্বগ্রাসী অতিমারির কোনও অভিজ্ঞতা আমাদের নেই।
আর এই প্রেক্ষিতে সরকারও দিশাহীন। দেশ চালাতে গেলে টাকা লাগে। আর সরকারের সেই টাকা আসে আমাদের দেওয়া করের টাকা থেকেই। দেশে যদি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে যেমন আমাদের গ্যাঁটে টান পড়ে, ঠিক তেমনই সরকারের কোষাগারও দীন হয়ে পড়ে।
তা হলে উপায়?
সাধারণ নাগরিক পেটের টানে ঘটি-বাটি বিক্রি করে দেয়। অনেকেই দারিদ্রের চাপে অবিমৃশ্যকারী হয়ে পড়ে। কিন্তু সরকার? অনেক সময়ই বিশ্বের ইতিহাস বলে, দেশের নেতৃত্বও কোষাগারের চাপে সাধারণ নাগরিকের মতোই অবিমৃশ্যকারী হয়ে পড়ে। আমরাও কি সেই রাস্তাতেই হাঁটছি?
কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত কিন্তু এই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, সরকারের কাজ ব্যবসা করা নয়। তাঁরা যে ভুল বলছেন, তা নয়। আবার যাঁরা উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে গোটা উদ্যোগকেই উড়িয়ে দিতে চাইছেন, তাঁদের যুক্তির সারবত্তাও অবহেলা করার মতো নয়। আসলে এই আলোচনাটা আমরা করে চলেছি যুক্তির প্রেক্ষিতকে সামনে তুলে না এনে।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মে মাসে পর পর পাঁচ দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে কোভিড মোকাবিলায় সরকার কী করবে তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। মে মাসের ১৭ তারিখের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারীকরণের কথা বলেন। এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় চিনের রাস্তায় হেঁটে তিনি বোঝাতে চান যে, সরকারি সংস্থা তাঁরা বেসরকারি হাতে তুলে দেবেন না। তাঁদের ইচ্ছা, এই সংস্থাগুলিকে ‘করপোরেটাইজ’ করা।
আরও পড়ুন: মুনাফার নিরিখে ভাতা, নতুন পথে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, চিন নব্বইয়ের দশকে যখন অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর রাস্তায় হাঁটে, তখন সেই সরকারেরও পরিকল্পনা ছিল ছোট সংস্থাকে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিয়ে, বড় সংস্থাগুলিকে ‘করপোরেটাইজ’ করা। বেসরকারি ঢংয়ে চালানো, কিছু শেয়ার বাজারে ছেড়ে সংস্থাগুলির উপর সরকারি মালিকানা রেখেই। আমাদের সরকারের উচ্চারণেও কিন্তু চিনের রাস্তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।
মে মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারীকরণের কথা জানান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ফাইল ছবি।
কেন?
সীতারামনের যুক্তি ছিল— বাজারের পথে সংস্থাগুলি পরিচালিত হলে, এই সংস্থাগুলি অনেক দক্ষ হয়ে উঠবে। সে ছিল মে মাসের ব্যাখ্যা। কিন্তু জীবন গতিশীল। এখন বোধ হয় সরকার সব বেচে কোষাগার ভরতে চাইছে। অন্তত অনেকেরই ধারণা তাই।
আসলে এখন প্রশ্ন সরকারের ব্যবসা চালানো বা না-চালানো নিয়ে নয়। সরকারের হাতে থাকা বৃহৎ সংস্থাগুলি যদি বিক্রি করতেই হয়, তা হলে সরকারের মালিকানা কতটা থাকবে, অথবা আদৌ থাকবে কি না প্রশ্ন তা নিয়েই। আর যদি না থাকে, তা হলে বেসরকারীকরণ কী ভাবে করা হবে?
আসলে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধীদের একটা বড় অংশ এই দ্বিতীয় প্রশ্নটা নিয়ে চিন্তিত। ২০১৮ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক রিসার্চ অবজারভার’-এর ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় সল এস্ট্রিন ও অ্যাডেলাইন পেটিয়ারের করা সমীক্ষার সার কথাটা ছিল— শুধু বেসরকারীকরণে কোনও দেশের আর্থিক উপকার হয় না। ঠিক মতো আইনি ব্যবস্থা বা আর্থসামাজিক অবস্থা খতিয়ে না দেখে এই রাস্তায় হাঁটলে উল্টে দেশের ক্ষতিই হয়।
আরও পড়ুন: উৎসাহ ভাতা আরও পাঁচ ক্ষেত্রকে, ইঙ্গিত কেন্দ্রের
এর মানে এই নয় যে, সরকারের ব্যবসা চালানোকে সমর্থন করা হচ্ছে। কিন্তু গত শতকের ষাটের দশকের পরে যখন গরিব দেশেগুলির সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা তৈরির রাস্তায় হাঁটে, তখন সেই সব দেশে বেসরকারি হাতে সেই টাকা ছিল না যা দিয়ে বড় ইস্পাত কারখানা বা ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা তৈরি করা যায়। যেমন আমাদের দেশে দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনায় ঠিক করা হয়, সরকারই এ সব করবে যাতে বাজার গড়ে ওঠে। চাকরির পরিসর তৈরি হয়। আর এই সব সংস্থার উৎপাদন নিয়ে ছোট সংস্থারা ব্যবসা গড়ে তুলতে পারে। এই পথে অনেক ভুল পদক্ষেপ হয়েছিল তা যেমন সত্যি, আবার এটাও সত্যি যে ভেল, হ্যাল বা সেল-এর মতো সংস্থা এই সময়েরই অবদান আজ যাদের মালিকানা নিয়ে এই বিতর্ক।
ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল শোধন সংস্থাটির কৌশলগত এই বিলগ্নিকরণ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ছবি: শাটারস্টক
আসলে বিতর্কের মূল জায়গাটা হল, সরকারি মালিকানার বেসরকারীকরণ না সংস্থার বেসরকারীকরণ বা করপোরেটাইজেশন? আমাদের দেশের আয়ের বৈষম্য বহুচর্চিত। ভারতে ১০ শতাংশের হাতে দেশের সম্পদের ৭৭ শতাংশ সম্পদ। এই অবস্থায় সরকার যদি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সব অধিকার বেসরকারি হাতে তুলে দেয় তা হলে এই বৈষম্য আরও বাড়বে বই কমবে না।
আর যাঁরা এই পূর্ণ বেসরকারীকরণের বিরোধী তাঁরা বলছেন, সম্পদ বৈষম্যের এই ছবিটা যদি না পাল্টায়, তাতে উন্নয়নের ক্ষতি বাড়বে বই কমবে না। যেমন এয়ারপোর্ট বেসরকারীকরণ। যে ছয়টি এয়ারপোর্ট বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কথা হচ্ছে তার প্রতিটির মালিকানাই যাচ্ছে আদানিদের হাতে।
সমস্যা হচ্ছে এখানেই। সম্পদের অধিকারই কিন্তু শেষে গিয়ে সিদ্ধান্তের অধিকার হয়ে দাঁড়ায়। যে দেশগুলি আজ উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠেছে, সেই সব দেশেই কিন্তু সম্পদের বণ্টনে সাম্য রয়েছে। আর তা আছে বলেই সাধারণ নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ কিন্তু অনেক দেশের কাছেই ঈর্ষণীয়। কারণ, সিদ্ধান্তের অধিকারও সম্পদ বণ্টনের হাত ধরে অনেক বেশি সাম্যের পথে হাঁটে। আর হ্যাঁ। তা কিন্তু হয়েছে বাজার অর্থনীতির হাত ধরেই। তাই এই মুহূর্তে যে প্রশ্নটা বেসরকারীকরণ বিতর্কের মূল জায়গা নিয়ে রয়েছে, তা ঠিক বেসরকারীকরণ নিয়ে নয়। দক্ষতার স্বার্থে বেসরকারীকরণ নিয়ে কিন্তু বর্তমান বিতর্ক দানা বাঁধছে না। সরকারি মালিকানা একক ব্যক্তি মালিকানার রাস্তায় হাঁটতে চলেছে কি না, প্রশ্নটা তা নিয়েই। আর বিতর্কের জায়গাটা এখন কিন্তু এটাই।