ফাইল চিত্র।
করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যু যত বাড়ছে, ততই চুপসে যাচ্ছে আশার ফানুস। জীবনযাপনের ছন্দে ফেরার যে আশা পোক্ত করছিল অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার রাস্তাটা। এমনকি দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পরেও মনে হয়েছিল এ বারের ক্ষয়ক্ষতি হয়তো আগের বছরের তুলনায় কমই হবে। কারণ দেশ জুড়ে লকডাউনের পরিবর্তে স্থানীয় ভিত্তিতে কিছু বিধিনিষেধ চালু হচ্ছে। প্রত্যাশার আর একটি কারণ ছিল প্রতিষেধক। টিকাকরণ দ্রুত গতিতে হলে সংক্রমণে লাগাম পরানো যাবে, এই বিশ্বাস লগ্নিকারীদের মনের জোর আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে উৎপাদন এবং বিক্রি চালু থাকলে অর্থনীতি হয়তো তেমন ধাক্কা খাবে না, সরকারের এই ভরসায় উজ্জীবিত হচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তব ছবিটা যে অনেক বেশি উদ্বেগের তা এতদিনে পরিষ্কার। দেশে দৈনিক ৩.৫ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ সংক্রমণ এবং ৪০০০ পেরিয়ে যাওয়া মৃত্যু পূর্ণ লকডাউনের পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে অনেক রাজ্যকেই। তার উপরে টিকাকরণের পরিকল্পনাহীনতা প্রকট। প্রতিষেধকে ঘাটতি টিকাকরণের গতি শ্লথ করেছে এতটাই যে, তৃতীয় ঢেউ আসার আগে সুরক্ষার ঢাল তৈরি করা যাবে কি না, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সব থেকে বড় প্রশ্ন।
পরিস্থিতি যা, তাতে অর্থনীতির উপরে আঘাত আসবেই। কতটা আসবে তা এখনই অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয় ঢেউ কাটতে কত সময় লাগবে, সেটাও জানা নেই কারও। ফলে যে আশঙ্কাগুলি নতুন করে দানা বাঁধছে তা হল—
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া অন্যান্য পণ্যের চাহিদায় ফের কোপ।
আবার শিল্পে উৎপাদন কমে যাওয়া।
নতুন করে রুজি-রুটিতে ধাক্কা। কর্মহীনের সংখ্যা বৃদ্ধি।
বহু ছোট-মাঝারি ব্যবসার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
সব মিলিয়ে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া মাঝপথেই ফের থমকে যাওয়া। কারণ, এই সবের সামগ্রিক প্রভাবে আশার তুলনায় অনেকটাই কমতে পারে জাতীয় উৎপাদন। মাস দুই তিন আগে যে সব আর্থিক উপদেষ্টা এবং মূল্যায়ন সংস্থা চলতি অর্থবর্ষে ভারতে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল, তারা ইতিমধ্যেই তা ছাঁটতে শুরু করেছে।
মোদ্দা কথা, করোনার প্রথম ঝাপটা এবং তাকে রুখতে গোটা দেশে দীর্ঘ লকডাউন অর্থনীতিতে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, শুকোনোর আগেই তার উপরে ফের চোট লেগেছে দ্বিতীয় দফায়। ফলে ক্ষতি যে আরও অনেক বেশি হতে পারে, সেটা বলাই বাহুল্য। এই পরিস্থিতি বিচার করে তুমুল অস্থির শেয়ার বাজার। গত সপ্তাহের চারটি লেনদেনে সেনসেক্স ৪৭৩ পয়েন্ট নেমে হয়েছে ৪৮,৭৩৩ অঙ্ক। বেশি পড়েছে ছোট-মাঝারি সংস্থাগুলির শেয়ার। রাজ্যে রাজ্যে বাধানিষেধ, চাহিদার দফারফায় অনেক বেশি ক্ষতির মুখে পড়ার ভয় যাদের।
তবে পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেশের মধ্যে অর্থনীতির পরিস্থিতি ততটা খারাপ বলে মনে হবে না। যেমন, গত মার্চে শিল্পোৎপাদন বেড়েছে ২২.৪% হারে। কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধিও বিরাট দেখাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এতটা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল আগের বছরের মার্চে অত্যন্ত নীচু ভিতের সঙ্গে তুলনা করে এ বারের হিসেব কষা। মূল্যবৃদ্ধির হারও এপ্রিলে স্বস্তি পাওয়ার মতো। মার্চের ৫.৫২ শতাংশের জায়গায় এপ্রিলে খুচরো বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ৪.২৯%। কিন্তু এটা জিনিসপত্র, খাদ্যপণ্যের দাম কমা না কি অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় চাহিদায় কোপ পড়ার প্রতিফলন, ধন্দ রয়েছে তা নিয়ে। আসলে মানুষ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে অত্যাবশ্যক পণ্য ছাড়া অন্য কিছুতে তেমন খরচ করতে চাইছেন না। তার উপরে যে ভাবে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ছে, তাতে চড়ছে পণ্যের পরিবহণ খরচ। বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউন শুরু হওয়ায় জোগান-শৃঙ্খলেও ধাক্কা লাগতে পারে। ফলে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধিতে ওই দৈত্যের মতো হার যেমন ধরে রাখা সম্ভব নয়, তেমনই মূল্যবৃদ্ধির হার কতদিন এমন ‘স্বস্তি জোগানোর’ মতো দেখাবে
প্রশ্ন থাকছেই।
লগ্নিকারীরা সব সময় আগামী সম্ভাবনার নিরিখেই পুঁজি ঢালার সিদ্ধান্ত নেয়। তা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্যই হোক বা সঞ্চয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে। ফলে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মেপে সংস্থা যেমন উৎপাদন বাড়াবে, তেমনই স্পন্দিত হবে শেয়ার বাজার। এই হিসেবে বলতেই হয়, আগামী মাস দুয়েক দেশের পক্ষে কঠিন সময়। অর্থনীতির জমিটা নড়বড়ে। এবং শেয়ার বাজারের আকাশে কালো মেঘ। টিকাকরণের পরিকল্পনাহীনতা, প্রতিষেধকের অপ্রতুল জোগানের মতো সমস্যা দ্রুত কাটাতে পারলে অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা মিলতে পারে।
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy