ছবি: এএফপি
ইউরো, কোপা এবং ব্রেক্সিট নিয়ে গোটা সপ্তাহটা ছিল চরম উত্তেজনাময়। অন্য দুটো টুর্নামেন্ট ফাইনালের দিকে এগোলেও ব্রেক্সিটের ফাইনাল ম্যাচ কিন্তু হয়ে গিয়েছে গত বৃহস্পতিবার। নিয়ম অনুযায়ী এক পক্ষ জিতেছে। ফলে ব্রিটেনের জনসংখ্যার একটি অংশ বেশ উল্লসিত। কিন্তু বাকি বিশ্বে ব্যাপারটা অন্য রকম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কালো মেঘ ডেকে এনেছে বিশ্ব জুড়ে।
এর থেকে রেহাই পাবে না খোদ ব্রিটেনও। ফলে ব্রেক্সিট ভোটের ফলাফল শুক্রবার প্রকাশিত হওয়া মাত্র ধস নামে গোটা বিশ্বের শেয়ার বাজারে। রক্তস্নাত হয় ভারতীয় বাজারও। একগুচ্ছ শিল্পে সরাসরি বিদেশি লগ্নির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে সাময়িক ভাবে ‘রেক্সিট’ (রাজনের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত) -এর প্রভাব থেকে রেহাই পেলেও ব্রেক্সিটের প্রকোপ কিন্তু আটকে রাখা যায়নি। এর জেরে শুক্রবার মহাপতন নেমে আসে ভারতীয় শেয়ার বাজারে। আতঙ্ক বাজারকে গ্রাস করায় এক সময়ে সেনসেক্স নেমে আসে হাজার পয়েন্টেরও বেশি। পরে সুযোগসন্ধানীরা এই পতনকে কাজে লাগিয়ে সস্তায় ভাল শেয়ার কিনতে নেমে পড়ায় সূচকের লোকসান খানিকটা কমে। ৬০৪ পয়েন্ট খুইয়ে সেনসেক্স নামে ২৬,৩৯৮ অঙ্কে। নিফ্টির পতন হয় ১৮২ পয়েন্ট। পৌঁছয় ৮০৮৯ অঙ্কে।
শুধু শেয়ার সূচকই নয়, আতঙ্কিত বাজারে ডলারে বড় পতন হয় ভারতীয় টাকারও। ৭১ পয়সা কমে টাকায় ডলারের দাম পৌঁছয় প্রায় ৬৮ টাকায় (৬৭.৯৬ টাকা)। শেয়ার বাজারে যখন চরম অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক যখন গ্রাস করে গোটা বিশ্বের বাজারকে, আগুন লাগা ঘরের মানুষদের মতো তখন লগ্নিকারীরাও ছোটেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। যা পাওয়া যায় হলুদের দুনিয়ায়। সেই কারণে শেয়ার বাজারে যখন চলছে মহাপতন, তখন এক ঝটকায় সোনার দাম ১৪০৫ টাকা বাড়ায় ১০ গ্রামের দাম পৌঁছেছে ৩১,৬৫৫ টাকায়। অর্থাৎ এই গরমেও পৌষ মাসের সুখ উপভোগ করছেন কিছু মানুষ। লাভ ঘরে তোলার তাগিদে শনিবার সোনার দাম ৪৮৫ টাকা নেমে এলেও অনিশ্চিত বাজারে এখন সোনার চাহিদা বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। যাঁরা গোল্ড ইটিএফে এবং মিউচুয়াল ফান্ডের একাংশ সোনায় লগ্নি করে রেখেছেন, ব্রেক্সিট তাঁদের কাছে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ব্রেক্সিটের প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে যখন টালমাটাল অবস্থা, তখন মার্কিন মুলুকে যে-এখনই সুদ বাড়ছে না, তা অবশ্য ধরেই নেওয়া যায়। এই কারণেও সোনা এখন শক্তিশালী থাকার কথা।
বিশ্ব অর্থনীতির কাছে ব্রেক্সিটের প্রভাব কিন্তু মাত্র দিন কয়েকের নয়। এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। খোদ ব্রিটেনেও পড়বে এর বড় রকমের প্রভাব। অর্থমন্ত্রী যা-ই বলুন, এর ভাল রকম ধাক্কা পৌঁছবে ভারতীয় অর্থনীতির উপরেও। চলুন দেখে নিই এক নজরে।
• ইউরোপের মধ্যে ভারতের সব থেকে বেশি ব্যবসা ব্রিটেনের সঙ্গে। ব্রিটেন কিছুটা দুর্বল হলে ভারতের ব্যবসা মার খাবে।
• ভারতের অনেক সংস্থার সরাসরি ব্যবসা আছে ব্রিটেনে। যেমন টাটা স্টিল এবং টাটা মোটরস। ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই সব কোম্পানি। এ ছাড়া অনেক ভারতীয় কোম্পানিই ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করে ইংল্যান্ডের মাধ্যমে। মার খাবে এরাও।
• এমনিতেই ইউরোপের অর্থনীতির হাল খারাপ হওয়ায় একনাগাড়ে মার খাচ্ছে ভারতীয় রফতানি। ব্রেক্সিট-উত্তর পর্বে অবস্থা আরও খারাপ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
• যদি রফতানি আরও কমে এবং অন্য দিকে তেলের দাম বাড়তে থাকে, তবে বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারে টান পড়তে পারে। ডামাডোলের বাজারে বিদেশ থেকে লগ্নি আসা কমতে পারে। এতে বেড়ে উঠবে ডলারের দাম। বিপাকে পড়বে আমদানি-নির্ভর শিল্পগুলি। আশার কথা, ভারতে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার এখন বেশ মজবুত। ১৭ জুন শেষ হওয়া সপ্তাহে ভারতের বিদেশি মুদ্রাভাণ্ডারে ছিল ৩৬,৩৮০ কোটি ডলার, অর্থাৎ কমবেশি ২৪.৫০ লক্ষ কোটি টাকা। অরুণ জেটলি এখান থেকেই ব্রেক্সিটকে মোকাবিলা করার শক্তি পাচ্ছেন বলে মনে হয়।
• ব্রেক্সিটের কারণে এর পর বিদেশিদের ব্রিটেনে কাজ পাওয়া শক্ত হবে। এর প্রভাব পড়তে পারে অনাবাসী ভারতীয়দের উপরেও।
• ব্রিটেনের পথ অনুসরণ করে আরও দু’চারটি শক্তিশালী অর্থনীতি যদি ইইউ থেকে বেরিয়ে যায়, তবে ভেঙে পড়তে পারে ওই সংগঠনের কাঠামো। এ রকম হলে সঙ্কট ঘনীভূত হবে বিশ্বময়।
এ বার তাকানো যাক আমাদের অর্থনীতির দিকে। মোদী এখন কোমর বেঁধে নেমেছেন সংস্কারের পথে। জিএসটি-র কাঁটা অনেকটাই দূর হওয়ার আশা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শিল্পে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের মাত্রা ১০০ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদিত হওয়ায় এ দেশে বিদেশি লগ্নির পথ আরও সুগম হবে। বর্ষা এসেছে, কিন্তু বিক্ষিপ্ত ভাবে। কোথাও এখনও চলছে একরকম অনাবৃষ্টি। অন্যত্র অতিবৃষ্টি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বত্র যদি বর্ষণ হয়, তবে তা এ দেশের জন্য আশার বার্তা বয়ে আনবে।
গত কয়েক সপ্তাহে ভালই এগোচ্ছিল শেয়ার বাজার। বাদ সাধল প্রথমে রেক্সিট ও পরে ব্রেক্সিট। এদের মোকাবিলা করতে কিন্তু সময় লাগবে। এই কারণে এখন বড় রকমের আশার কথা শোনানো যাচ্ছে না ভারতীয় বাজার সম্পর্কে।
সঙ্কটের সপ্তাহে ভাল খবর হল জুলাই থেকে পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডে (পিপিএফ) সুদ কমানো হচ্ছে না। অন্য দিকে কয়েকটি বিশেষ শর্তে পিপিএফ অ্যাকাউন্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বন্ধ করার ব্যাপারটি কেন্দ্রের অনুমোদন পেয়েছে। এ ছাড়া আর একটি ইটিএফ বাজারে ছাড়ার ব্যাপারে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে নামী সরকারি কোম্পানি ছাড়াও থাকবে আইটিসি, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক, এলঅ্যান্ডটি ইত্যাদির মতো বেসরকারি ব্লু-চিপও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy