Advertisement
E-Paper

একটু আগে শুরু করলে ক্ষতি কী?

ছোটবেলায় ভাঁড়ে পয়সা ফেলতে শিখিয়েছিলেন মা। বড় হয়ে সেটাই হয়ে উঠুক না ব্যাঙ্ক, শেয়ার, ফান্ড! লগ্নির পাঠ নেওয়া থাকলে, মাঠ পাল্টালেও খেলতে অসুবিধা হয় না। জানাচ্ছেন অমিতাভ গুহ সরকারছোটবেলায় ভাঁড়ে পয়সা ফেলতে শিখিয়েছিলেন মা। বড় হয়ে সেটাই হয়ে উঠুক না ব্যাঙ্ক, শেয়ার, ফান্ড! লগ্নির পাঠ নেওয়া থাকলে, মাঠ পাল্টালেও খেলতে অসুবিধা হয় না

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
মূলধন বাড়াতে সঞ্চয়ে জোর দিন। ছবি: শাটারস্টক।

মূলধন বাড়াতে সঞ্চয়ে জোর দিন। ছবি: শাটারস্টক।

শীত আসার আগে ‌‌‌‌‌‌‌দেখা যায় খাবারের টুকরো মুখে নিয়ে সার বেঁধে চলেছে পিঁপড়ের দল। তাদের বাসায়। ঠান্ডা পড়লে আর বাইরে বেরোবে না তারা। তাই এ ভাবে খাবার জমানো একটু একটু করে। আবার কাকেরা ইতিউতি ওড়াউড়ির মাঝেই মাটি থেকে কুড়িয়ে নেয় গাছের ডাল। বাসা বাঁধবে বলে। মা-ঠাকুমাদের দেখেছি প্রতি দিন সকালে চাল নেওয়ার সময় এক মুঠো করে সরিয়ে রাখতেন খাটের তলার হাঁড়ি বা কৌটোয়। এটা নিশ্চিত করতে যে, গৃহস্থের বাড়িতে চাল যেন বাড়ন্ত না হয়।

এই সব ছবি ছোটবেলা থেকেই বড্ড চেনা। বড় হয়ে বুঝেছি, এগুলো আসলে জীবনে সঞ্চয়ের প্রথম পাঠও। আলাদা চাল জমিয়ে রাখাকে যদি আপৎকালীন তহবিল বলি, তা হলে পিঁপড়েদের শীতের খাবার জমানোকে ধরে নিতে পারি অবসরের সঞ্চয় হিসেবে। কাকেদের এমন নিরলস বাসা বাঁধার চেষ্টায় খুঁজে পেয়েছি মাথার উপরে ছাদ জোগাড়ের এক অদ্ভূত টান। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে অনেকগুলো প্রশ্ন, কেন জমাব? কী ভাবে? কোন উপায় পা বাড়াব লগ্নির পথে? কী কী খরচ এড়াতে পারব অনায়াসে? কোনটা নয়? কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় যদি জীবন গড়িয়ে যায়, তা হলে লাভ কী? বরং প্রথম পাঠের পথ ধরে যদি একটু আগে শুরু করা যায় সঞ্চয়, দেখবেন অপচয়ের অভ্যেস তো বদলাবেই। সেই সঙ্গে অজান্তে তৈরি হয়ে যাবে বড় মাপের তহবিল।

খরচের রকমফের

সঞ্চয় যেমন জরুরি, তেমন কিছু ক্ষেত্রে খরচও। তাই টাকা জমানোর পথে এগোনোর আগে বুঝে নিতে হবে, কোন খরচে রাশ টানা যায়, কোনগুলোতে নয়। যাতে প্রয়োজনের বরাদ্দ সরিয়ে রেখে সঞ্চয়ে নামা যায়।

এড়ানোর পথ নেই

কিছু খরচ না করলেই নয়। যেমন, সংসার খরচ, বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুতের বিল, নিয়মিত ডাক্তার-বদ্যি দেখানো বা ওষুধ-বিষুধ কেনা ইত্যাদি। ছেয়েমেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে স্কুল, কলেজের মাইনে না গুনে উপায় কী! তাদের কেরিয়ারে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলেও। এ সবের পাশাপাশি রয়েছে বিয়ে, মাথার উপরে ছাদ জোগাড়, পুজো-পার্বণ, নেমন্তন্ন, দায়-দায়িত্ব কিংবা উপহার খাতের হাজারো খরচও।

যা কিছু শখের

খরচে রাশ টানায় দক্ষতার পরীক্ষা হয় এখানেই। শখের খরচের মধ্যে পড়ে গাড়ি, দামি মোবাইল ইত্যাদি। যেগুলি কেনার পরে বাজারদর পড়তে থাকে বলে বিক্রি করে বেশি টাকা পাওয়া যায় না। রয়েছে বেড়াতে যাওয়া, বাইরে খাওয়াদাওয়া ইত্যাদিও। এই সব শখ মেটানোর তির এক বার হাত থেকে বেরিয়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না।

ফলে সঞ্চয়ের তহবিল তৈরি করতে সপ্তাহে এক বার বাইরে খাবেন না মাসে দু’বার, পুরী বেড়াতে যাবেন না মধ্যপ্রদেশ, সাধারণ মোবাইলেই কাজ সারবেন নাকি দু’বছর অন্তর স্মার্ট ফোন পাল্টাবেন, সেটা সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছে ও মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করবে। সঞ্চয়ের লক্ষ্য ছুঁতে যে নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

পরের ধাপ সঞ্চয়

কোথায় কত খরচ করতেই হবে, সেই তালিকা যেই তৈরি করে ফেললেন আপনার অর্ধেক কাজ সারা। এ বার প্রশ্ন সঞ্চয়ের। সেখানেও আগে প্রয়োজন এবং শখ, দু’টোকে আলাদা করতে হবে।

কোনটা জরুরি

জীবনের বিভিন্ন মোড়ে এমন কিছু প্রয়োজন মেটাতে টাকার ব্যবস্থা করে রাখতে হয়, যেটা না করা গেলে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। হাতছাড়া হতে পারে সুযোগ। এমনকি বন্ধ হতে পারে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলার রাস্তাটাই। সে সবই দরকারের সঞ্চয়। যেমন—

• বাড়ি কেনার জন্য ডাউনপেমেন্টের টাকা জোগাড়।

• ছেলেমেয়ের শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও বিয়ের ব্যবস্থা।

• ভবিষ্যতে নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের পরিসর তৈরি। এর মধ্যে অন্যতম অবসরের তহবিল (পেনশনের সুবিধা না থাকলে যার অঙ্ক আরও বেশি হতে হয়)।

• আপৎকালীন প্রয়োজন সামাল দেওয়ার বন্দোবস্ত।

• জীবন বিমা ও স্বাস্থ্য বিমার হাত ধরে পরিবারের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

অর্থাৎ এই তালিকায় সেগুলোই আছে, যা কি না, সচ্ছল ভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। শুধু আর্থিক নয়, গড়ে দেবে গোটা জীবনের ভিতই।

কোনটা শখ

শুনতে অবাক লাগবে। তবে শখ পূরণের সঞ্চয়ও আছে। যেমন ফ্ল্যাট বা বাড়ি। মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে হয়তো একটা। কিন্তু আরও একটু খোলামেলা বড়সড় জায়গায় থাকতে চাইলেন। সেটাই শখের ফ্ল্যাট। তবে প্রয়োজনে তা ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করা সম্ভব। যা দিয়ে কিনেছেন তার বেশি দামেই। ফলে এর হাত ধরে সম্ভব হয় আয়ের ব্যবস্থা করা। আবার শখ মেটানোর জন্য কেনা যায় সোনা বা হিরের গয়নাও। লগ্নির মাধ্যম হিসেবেও কদর যেগুলোর। এই ধরনের জিনিসের বাজারদর সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে। তাই এগুলিকে খরচের মধ্যে রাখা যায় না। আবার একেবারে ‘না হলেই নয়ে’র মতো সঞ্চয়ের তালিকাতেও রাখা যায় না। তাই সেগুলির নিরাপদ জায়গা শখের সঞ্চয়।

তবে দ্বিতীয় বাড়ির জন্য যদি ঋণের কিস্তি গুনতে হয়, তা হলে সেটি বিক্রি করে কতটা লাভ ঘরে আসবে তার হিসেব আগেই করতে হবে। আবার গয়নার ক্ষেত্রেও বিক্রির সময়ে বাদ দিতে হবে মজুরি।

দুইয়ের ফারাক

সঞ্চয় ও লগ্নি গুলিয়ে যায় মাঝে মধ্যেই। মনে রাখতে হবে, সব খরচের পরে যে টাকা সরিয়ে রাখা হয়, সেটা সঞ্চয়। আর সেই টাকা কোনও প্রকল্পে রেখে তহবিল বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হলে, তাকে লগ্নি বলে। কাজেই শুধু সঞ্চয় করে লাভ নেই। মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা সামলাতে সেই তহবিলের পরিকল্পনা মাফিক লগ্নি জরুরি।

আগে শুরুর সুফল

তবে সঞ্চয় হোক বা লগ্নি, শুরু করতে দেরি হলে ভুগতে হবে নিজেকেই। ধরা যাক, সমর আর রাহুল দুই বন্ধু। দু’জনেই এক সঙ্গে চাকরিতে ঢুকেছিলেন। বয়সও এক। প্রথম মাস থেকে সমর মাসে ১,০০০ টাকা করে ৮% সুদের প্রকল্পে রাখতে শুরু করেন ৩৫ বছরের জন্য। রাহুল সঞ্চয়ের পথে পা বাড়ান ৩৫ বছরে গিয়ে। রাখেন মাসে ১,৪০০ টাকা। ২৫ বছরের জন্য। ৬০ বছরে দেখা গেল দু’জনেই রেখেছেন ৪.২০ লক্ষ। কিন্তু সমরের জমেছে ২১,৫৭,৩৫৩ টাকা। আর রাহুলের ১২,৮২,১৭৫। কারণ, ১০ বছর আগে লগ্নি শুরুর কারণে চক্রবৃদ্ধির যে বাড়তি সুযোগ সমর পেয়েছিলেন, রাহুল তা পাননি। ফলে সমরের তুলনায় রাহুলের জমেছে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা কম।

ফলে সঞ্চয় ও লগ্নির পাঠ নেওয়া শুরু হোক একটু আগেই। প্রথমে একলপ্তে বড় টাকা ঢালতে না পারলে, নিয়মিত আয় শুরুর সঙ্গে সঙ্গে অল্প করে বিনিয়োগ করা জরুরি। আয় বাড়লে সেই অঙ্ক যেন বাড়ে।

বয়সের সঙ্গে

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা, ইচ্ছে, প্রয়োজন পাল্টে যায়। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টাতে হবে লগ্নিও। এ জন্য জরুরি বয়স মেপে সঞ্চয় করা—

১০-১৮: ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে সঞ্চয়ের শিক্ষা দিতে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দিন। হাতে ধরে শিখিয়ে দিন তা কী ভাবে ব্যবহার করতে হয়। এতে জমানোর অভ্যাস তৈরি হবে।

১৮-২৫: কলেজের পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই লগ্নির পাঠ নেওয়া শুরু করুন। জন্মদিন, পুজো, হাতখরচ বা টিউশনি করে হাতে আসা টাকা অল্প অল্প করে সরিয়ে রাখুন। হাতে আসা থোক টাকা কী ভাবে কোথায় রাখা যায়, জেনে নিন। এই অভ্যেস চাকরি জীবনে বোনাসের টাকা রাখার সুলুকসন্ধানও দেয়। চিনুন শেয়ার, ফান্ড, স্বল্প সঞ্চয়ের মতো লগ্নির ক্ষেত্রকে।

২৫-৩০: সাধারণত ২৫ বছর বা তার আগে-পরে চাকরির জগতে পা রাখি আমরা। কলেজে পড়ার সময়ে যে অভ্যেস তৈরির কথা বললাম, তাকেই নিয়মে বাঁধুন। লগ্নির জায়গাগুলি জানা থাকলে, শুরু থেকেই সেখানে টাকা রাখতে পারবেন। এই সময়ে সাধারণত দায়িত্ব কম থাকে। তাই ফান্ড বা শেয়ারের মতো বেশি ঝুঁকির ক্ষেত্রে টাকা রাখতে পারেন।

৩০-৩৫: এই বয়সে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়। তাই অবসর জীবনের পুঁজি তৈরি, সন্তানের পরিকল্পনা, তার জন্মের খরচের জন্য সঞ্চয়, উচ্চশিক্ষা, বিয়ে ইত্যাদির কথা মাথায় রেখে লগ্নি করতে হবে। পরিবারকে দিতে হবে স্বাস্থ্য বিমার সুরক্ষাও। সঙ্গে জীবন বিমা।

৩৫-৪৫: সংসারের দায়িত্ব আরও বাড়ে। তবু নিয়ম করে সঞ্চয় চালিয়ে যেতে হবে।

৪৫-৫৫: এই সময়ে জোর দিতে হবে অবসরের দিকে। করতে হবে সন্তানের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা কমে। এই বয়সে গিয়ে লগ্নি ছড়ানোর সময়েও সেটা মাথায় রাখুন।

৫৫-৬০: অবসরের লগ্নিকে গুছিয়ে আনতে হবে এই সময়। সন্তানের বিয়ের জন্য যে টাকা জমিয়েছেন, তা-ও তুলে সুরক্ষিত প্রকল্পে রাখার কথা ভাবতে হবে।

৬০-: যা জমেছে, তা অ্যানুইটি প্রকল্পে ঢালুন।যাতে মাসে মাসে হাতে টাকা আসে। পেনশন থাকলে ভালই। সেখান থেকে সংসার খরচের টাকা পাবেন।

কর বাঁচাতে

সঞ্চয়ের সঙ্গেই কিন্তু আসে কর বাঁচানোর প্রশ্ন। কারণ, রোজগারের পুরোটা সব সময় পকেটে আসে না। নির্দিষ্ট অঙ্কের চেয়ে বেশি আয় করলে দিতে হয় করও। কিছু প্রকল্পে লগ্নি করলে সেই করে ছাড় মেলে। তাই তহবিল বাড়াতে যেমন লগ্নি জরুরি, তেমনই কর বাঁচাতেও।

খেয়াল রাখুন

• লগ্নির আগে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা যাচাই করুন।

• কেউ চড়া রিটার্নের কথা বললেই চোখ বুজে সেখানে টাকা রাখবেন না।

• মন্দা বা অন্য কোনও কারণে বাজার ধসে না গেলে, সাধারণত শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ড বেশ ভাল রিটার্ন দিতে পারে। কিন্তু তার সুফল পেতে ধৈর্য ধরতে হবে।

• গুরুত্ব দিন স্থায়ী আমানত, ডেট ফান্ডের মতো ঋণপত্রে লগ্নিকেও। তহবিল ছড়াতে তা সাহায্য করবে।

• মূল্যবৃদ্ধির কথা খেয়াল রাখুন। তাই আজকের নয়, ভবিষ্যতের খরচের কথা ভেবে লক্ষ্য স্থির করুন।

• নিয়মিত প্রকল্পের অগ্রগতি খতিয়ে দেখুন। প্রয়োজনে পাল্টান।

• ঋণ নেওয়ার আগে ডাউনপেমেন্ট, কিস্তিতে কত টাকা যাবে হিসেব করুন। দেখুন, তা সাধ্যের মধ্যে থাকছে কি না। ব্যক্তিগত ঋণ নিতে বাধ্য হলে চেষ্টা করুন সেই টাকা দ্রুত মিটিয়ে দিতে।

• কোথায় টাকা রাখছেন, পরিবারের লোকজনদের তা জানিয়ে রাখুন।

• উত্তরাধিকারী ও নমিনিদের মধ্যে ঝামেলা এড়াতে উইল করুন। করতে পারেন দানপত্রও।

লেখক: বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

Savings EPF Share Market Mutual Fund
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy